আইন কি ধনী-গরিব বোঝে?
সারওয়ার-উল-ইসলাম:
আমাদের পুলিশ বাহিনী ইচ্ছে করলেই আসামিকে ধরতে পারে। এটা আমরা গর্ব করেই বলতে পারি। বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় একে একে পাঁচ আসামিকে তারা ধরতে পেরেছে। খুব অল্প সময়েই ধরা পড়েছে এই আসামিরা। এটার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
ধর্ষণের ঘটনাটি মিডিয়ায় যেভাবে প্রচার পেয়েছে, আর সমাজের নানা স্তরের মানুষ যেভাবে মতামত জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, সেটা অভাবনীয়। আমরা সমাজে ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে চাই না, তা গত দুই সপ্তাহের মিডিয়া ঘাটলেই টের পাওয়া যাবে।
কে বাদ গিয়েছে? সাবেক আইনমন্ত্রী, কথাসাহিত্যিক, মানবাধিকারকর্মী, জনপ্রতিনিধিসহ পুলিশের সাবেক আইজি। দোষীদের শাস্তি দাবি জানিয়ে তাঁরা সবাই পত্রিকায় পৃথক পৃথক মত দিয়েছেন, পাশাপাশি দোষীদের শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এর বাইরেও সমাজের বিভিন্ন স্তরের সচেতন মানুষের প্রতিবাদ ছিল নানাভাবে।
এখন দেখা যাক, সেই অপরাধী ও তাদের দোসরদের কি শাস্তি হয়। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
কিন্তু আমাদের কি মনে পড়ে সেই ছোট মেয়েটির কথা, তার বাবার কথা? গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা। গ্রামের নাম কর্ণপুর সিটপাড়া। এ গ্রামের হজরত আলী তাঁর আট বছরের পালিত মেয়ে আয়েশা আক্তারকে নিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ২৯ এপ্রিল। বখাটে কর্তৃক মেয়ের শ্লীলতাহানি ও প্রতিবেশীদের হামলার হুমকির বিচার না পেয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন হজরত আলী।
সেই ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ এখনো ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বরং এখনো হামলার আশঙ্কায় হজরত আলীর বাড়িতে দিনরাত পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আসামিরা প্রভাবশালী বলেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সাধারণভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, তা হলে কি এ মামলার ঘটনায় আসামি ধরার ব্যাপারে পুলিশের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে?
নাকি এই যুগল আত্মহত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়নি বা দেশের সুশীলসমাজ প্রতিবাদ জানায়নি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতটা তৎপরতা দেখাচ্ছে না? নাকি নিতান্তই অসহায় আর গরিব মানুষ বলে কোনোমতে চলছে আইনের চাকা।
আমরা তো সেই অমোঘবাণী ছোট থেকেই শুনে আসছি- আইনের চোখে সবাই সমান। ধনী-গরিব সবার জন্যই আইন সমান। তা হলে কেন এই যুগল আত্মহত্যার ঘটনাটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
আমরা অবশ্যই স্বীকার করি বনানীতে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাটি আমাদের কাছে মর্মস্পর্শী। কারণ এভাবে আরো কত তরুণীকে ওই সাফাত আর বন্ধু নাইম আশরাফরা নষ্ট করেছে আমরা হয়তো জানি না। হয়তো সেই তরুণীদের লোকলজ্জার ভয়ে সেগুলো আমাদের কাছে অজানাই থেকে যাবে। তাই এই অপরাধীদের দ্রুত বিচার হওয়া ছাড়া কোনো সহজ সরল পথ নেই। যেন অন্য ধনীর দুলালরা বুঝতে পারে অপরাধ করলে বাবার টাকা থাকলেও রক্ষা পাওয়া যাবে না। আইনের চাকা ধনী-গরিব বোঝে না। শাস্তি পেতেই হবে।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি, পুলিশ বাহিনী চাইলেই সব পারে, এটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই।
আমরা পত্রিকায় দেখেছি, খুনের আসামি জেলখানায় না থেকে আরাম আয়েশে দিন গুজরান করছে বারডেম হাসপাতালে। খুনের মামলার আরেক আসামি টাঙ্গাইলের এক সাংসদ হাসপাতালে ছিলেন। ৭৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত ইয়াবা ব্যবসায়ী জেলখানায় না থেকে ১৮ মাস ধরে বারডেমে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। এমনও শোনা গেছে, সে নাকি বাইরেও ঘুরে আবার হাসপাতালে এসেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কারা কর্তৃপক্ষ আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে। পরে তাদের আবার কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনা শুনে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী ধারণা জন্ম নেয় আইনের প্রতি?
তবে আমরা এখনো আশা করি, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের পুলিশ বাহিনী যদি মনে করে আসামি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তাকে আইনের কাছে সোপর্দ করবই, তা হলে তারা তা পারে। তাদের কাছে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য এক আইন।
হজরত আলীর মেয়েশিশুকে নিয়ে আত্মহত্যার পেছনে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের অতিসত্বর ধরে আইনের আওতায় আনা হবে। বনানীর ধর্ষণ ঘটনার আসামিদের পেছনে প্রভাবশালীদের চেয়ে তারা যত বড়ই হোক না কেন, তারা ধরা পড়বেই।
এই আশা আমরা করতে পারি।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।