বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি’

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
অক্টোবর ১, ২০১৭
news-image

১ অক্টোবর প্রবীণ দিবস। বর্তমানে দেশের প্রবীণদের অবস্থা লিখেছেন দোহার থেকে শওকত আলী রতন ও মানিকগঞ্জ থেকে আবদুর রাজ্জাক। সব জায়গায়ই প্রবীণরা অবহেলার শিকার। আমরা চাই যত্নে থাকুন প্রবীণরা। সব প্রবীণকে প্রবীণ দিবসে শুভেচ্ছা।

প্রবীণ শব্দটা শোনামাত্রই আমাদের চোখের সামনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, তা হলো একজন শুভ্রকেশধারী মানুষ, যিনি বয়সের ভারে ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাতর। কেউ কেউ অসহায়ভাবে জীবনযাপন করে থাকেন। আমরা তাদের সম্মান মর্যাদা কতখানি দিয়ে থাকি জানি না, তবে অযত্ন-অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারলে যেন বাঁচি। মনে করে থাকি বৃদ্ধ আর ক’দিন বাঁচবে? তার জন্য সময় নষ্ট করার দরকার কী? এটা কখনো আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা মূল্যবোধ হওয়া উচিত নয়।

প্রবীণ শরিফা বেওয়ার বয়স ৭০ পেরিয়েছে বছরখানেক আগেই। মানিকগঞ্জের বরংগাইল এলাকায় থাকেন অন্যের দয়ায় এক পরিত্যক্ত ভিটেবাড়িতে। দুই মেয়ে ও এক শিশু ছেলেকে রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর শরিফা বেওয়ার দুঃখের জীবনের শুরু। জীবনের তাগিদে আর সন্তানদের মুখে দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে তিনি মাটি কাটার কাজ, অন্যের বাড়িতে, হোটেলে ঝিয়ের কাজ করেছেন। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হতো তার জীবন সংগ্রাম; সূর্য ডোবার পরও যেন তা শেষ হওয়ার নয়। এমনি করে কেটে গেছে জীবনের ৩০টি বছর।

ছেলের পড়াশোনা আর মেয়ে দু’জনকে বিয়ে দিতে বিক্রি করতে হয় স্বামীর শেষ সম্বল ভিটেটুকু। ছেলে এখন বিয়েশাদি করে গাজীপুরে থাকে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনই পোশাক তৈরি কারখানায় চাকরি করে। ছেলেমেয়েরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকলেও খোঁজ নেয় না বৃদ্ধ মায়ের। বয়স হয়ে গেছে, এখন আর আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। তবুও পেটের তাগিদে তার জীবন যুদ্ধ যেন ফুরায় না। অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের কাছে হাত পেতে জীবনকে ঠেলে নেয়ার শেষ চেষ্টারত দুঃখিনী শরিফা বেওয়া আহাজারি, ‘আল্লাহ এত মানুষ নেয়, আমারে ক্যান মরণ দেয় না।’

রাশেদা বেগম নামের ৭৩ বছরের এক মায়ের ‘দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের আশ্রয়ে ছিলেন। ভাই মারা যাওয়ার পর ছেলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। সেই যে গেছে, আর কোনো দিন দেখতে আসেনি। আমাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কী এমন অসুবিধা হতো? তার পরও আমি তো মা। তাই তো সব সময় চাই, আমার ছেলেমেয়েরা ভালো থাকুক, আরো বড় হোক।’ জীবনের পড়ন্ত বেলায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়েছে তার। বছর সাতেক আগে গাজীপুরের মনিপুর বিশিয়া এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেন তিনি।

ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি।’… জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর গাওয়া এই গানের মতোই কম দামি বনে যাওয়া রাশেদা বেগমের মতো আরো অনেকেরই জীবনসায়াহ্নে এসে ঠাঁই নিয়েছেন এখানে। আবার শরিফা বেওয়ার মতো অনেক অসহায় প্রবীণ জীবন যন্ত্রণা আর স্বজনদের উপেক্ষার শিকার হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করে বেঁচে আছেন। আত্মীয়স্বজন, সন্তানের সান্নিধ্য, সন্তানকে একটু দেখার জন্য যেন কাঙালের মতো পথ চেয়ে থাকেন উপেক্ষার শিকার একেকজন প্রবীণ। প্রিয় সন্তান তাদের দূরে ঠেলে দিলেও দিনমান সেই সন্তানেরই মঙ্গল কামনা করেন তারা।

আগেকার সমাজে বৃদ্ধজন বেশ সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বৃদ্ধদের ওপর এই শ্রদ্ধা ও সম্মান অক্ষুণœ ছিল। বিশেষ করে প্রাচ্য সমাজে বৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য আজো মোটামুটি লক্ষ করা যায়। পক্ষান্তরে, শিল্পোন্নত দেশগুলোয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হওয়ায় বৃদ্ধদের মর্যাদা কমে গেছে। সেখানে প্রবীণদের বস্তুগত কল্যাণ ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে অবশ্য চেষ্টা যে হচ্ছে না, তা নয়। প্রাচ্যের বৃদ্ধজনেরা যেমন সম্মান ও যতœ পান পুরো সমাজ ও পরিবারের পক্ষ থেকে পশ্চিমা সমাজে তেমনটি নেই। উন্নত সমাজের বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।

ইসলাম বৃদ্ধদের শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়েছে। রাসূলে সা: বলেছেন : যে ব্যক্তি একজন বয়োবৃদ্ধের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে কিয়ামতের দিন সব ভয়ভীতি আশঙ্কা থেকে নিরাপদ রাখবেন। বৃদ্ধদের শ্রদ্ধা বা সম্মান করা আর ছোটদের স্নেহ করা ইসলামি নৈতিকতার অন্যতম বিধান। লেখকঃ আবদুর রাজ্জাক