শুক্রবার, ১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভারী বর্ষণে দেশজুড়ে দুর্ভোগ

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
অক্টোবর ২৪, ২০২০
news-image

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা দিয়ে এটি উপকূল অতিক্রম করে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল শুক্রবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে আজ শনিবার থেকে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসবে। এ সময়ে ঢাকাসহ দেশের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে। রোদের দেখা মিলতে পারে আগামীকাল নাগাদ। আজ আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে শুরু করবে, অর্থাত্ আর খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৪ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বৈরী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ফেরি সার্ভিসসহ দেশের অভ্যন্তরীণ সব রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নিম্নচাপটি বৃষ্টি ঝরিয়ে স্থল নিম্নচাপ আকারে ফরিদপুর-মাদারীপুর ও তত্সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। স্থল নিম্নচাপটির কেন্দ্রের ৪৪ কি. মি. এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার; যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
নিম্নচাপের প্রভাবে দুই দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। কোথাও থেমে থেমে আবার কোথাও মুষলধারে তুমুল বৃষ্টি। উপকূলীয় নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোয় বাড়িঘর, ফসলিজমি ও মাছের ঘের জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন এলাকার মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। রবিশস্য ও আমন ধানের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, মোংলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, ভোলাসহ উপকূল সংলগ্ন জেলাগুলোর অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি প্রবেশ করেছে অনেক বসতবাড়িতেও। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা। মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদী তীরবর্তী এলাকা তিন থেকে চার ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
টানা বৃষ্টিতে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ছুটির দিন হলেও ব্যক্তিগত কাজে এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাচলকারীরা ব্যাপক দুর্ভোগের শিকার হন। বিশেষ করে মিরপুর, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, শান্তিনগর, মালিবাগ, কাওরান বাজার এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বেশ বেগ পেতে হয়েছে পথচারীদের। কর্মজীবী শ্রমিকদের দুর্ভোগ ছিল বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান। দেশে সর্বোচ্চ ২৫৪ মিলি বৃষ্টিপাত হয়েছে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়। সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে সিলেট বিভাগে, মাত্র ১১ মিলিমিটার।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম বা তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। আজ শনিবার রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে।

চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ভারী বৃষ্টিপাতে বন্দরনগরীর প্রায় অর্ধশতাধিক নিচু এলাকা হাঁটু থেকে কোমর পানির নিচে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় বিভিন্ন সড়ক ডুবে গেলে বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, নাসিরাবাদ সিডিএ অ্যাভিনিউতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রকট যানজটে ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বৃষ্টির কারণে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের ঢালে ও পাদদেশে বসবাসরত মানুষজনকে সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের জন্য নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আমদানি পণ্য খালাস ও লাইটারিং কার্যক্রম উত্তাল ঢেউয়ের কারণে বন্ধ ছিল। পণ্য খালাসের জন্য বহির্নোঙরে ৫৫টির মতো মাদার ভেসেল অপেক্ষমাণ রয়েছে। এদিকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোর শিডিউল বিলম্বিত হয়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস থেকে আবহাওয়াবিদ শেখ ফরিদ আহমেদ জানান, গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে আজও।

বরিশাল অফিস জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বরিশালের অভ্যন্তরীণ ১৩ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। তবে ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চ চলাচল করছে। এদিকে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নগরীর বিভিন্ন সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নগরজীবন। খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হন।

বরগুনা (উত্তর) প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকেই জেলায় ভারী বৃষ্টিসহ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। জোয়ারের প্রভাবে জেলার নদনদী পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। অধিকাংশ ধানখেত ও রবি ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। সকল প্রকার নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৫০৯টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ ৭৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে নাব্যসংকটে ৯ম দিনের মতো ফেরি এবং বৈরী আবহাওয়ায় ২য় দিনের মতো লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। নারী শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ আটকা পড়েছে ঘাটে। ফলে এই রুটে চলাচলকারী দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। এদিকে লৌহজং উপজেলার কলিকালচরের কাছে গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে পদ্মায় ইঞ্জিনচালিত একটি জেলে নৌকা ডুবে যায়। এতে দুই শিশু নিখোঁজ হলেও পরে তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, গত দুদিন থেমে থেকে জেলায় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। নিম্নাঞ্চলে অস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। মোংলা বন্দরে জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টিতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। মোংলা বন্দরে হারবার মাস্টার মো. ফকর উদ্দিন বলেন, বন্দরে বর্তমানে ইউরিয়া সার, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, এলপিজি গ্যাসসহ মোট ১১টি পণ্যবাহী জাহাজ অবস্থান করছে। পণ্য ওঠানামার কাজ কিছুটা ব্যাহত হলেও বন্ধ নেই।

মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার ১৬ ইউনিয়নে সাড়ে ৩ হাজার মত্স্য ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। পৌরসভাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ।

শরণখোলা (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, দুদিনের ভারী বর্ষণে উপজেলার গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। ভেসে গেছে কয়েক শ পুকুর ও ঘেরের মাছ। থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

ভোলা (দক্ষিণ) প্রতিনিধি জানান, ভোলা-বরিশাল ও ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ফেরি সার্ভিস বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জেলার অভ্যন্তরীণ সব রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। পুরো জেলায় অব্যাহত বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদী তীরবর্তী এলাকা তিন-চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে।

রামগতি (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা জানান, মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার ফুট বেড়ে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার একর উঠতি রোপা আমন ধানের জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুর নৌ-বন্দরকে স্থানীয়ভাবে ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে চলাচলকারী ছোট লঞ্চগুলোর চলাচল বন্ধ রয়েছে।

খুলনা অফিস জানায়, সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে খুলনায় ১১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ১১৬টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। যারা ইতিমধ্যে উপকূলীয় জনগণকে সচেতন করতে মাইকিংসহ নানামুখী প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন।