বৃহস্পতিবার, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বন্যার অবনতি, বহু মানুষ পানিবন্দি

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
জুন ২৯, ২০২০
news-image

উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিপুল মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

হাজার হাজার বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। পানিবন্দি বহু মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যায় পড়েছেন বন্যা কবলিত এসব এলাকার মানুষ। অনেক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি কমলেও এখনও বিপদসীমার উপর প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা শহরে বাড়িঘরে ওঠা পানি নামতে শুরু করেছে। ধরলা, ব্রহ্মপূত্র, যমুনা, ঘাঘট ও সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার উপর প্রবাহিত হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ধরলা ও ব্রহ্মপূত্র নদের পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ১৬টি নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫০টির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

একদিকে করোনাভাইরাসের কারণে টানা তিনমাস ঘরে বন্দি। তার উপর বন্যার ধাক্কায় মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপূত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং চিলমারী পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল সন্ধ্যা ৬টায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান প্রধান জানান, বন্যায় ১ হাজার ৬৯২ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। তবে বেসরকারিভাবে নিমজ্জিত বা ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার হেক্টর বলে সংশ্লিষ্ট কৃষক ও ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যায় ৩০২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের পাশাপাশি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, জেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রোববার সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বসতবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এসব বসতবাড়ির প্রায় ১৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষ ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু তারা বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যার পড়েছেন। এদিকে ঘাঘট নদীর পানির চাপে শহররক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।

বন্যা কবলিত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা, হরিপুর, তারাপুর, কাপাসিয়া, গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি, এরেন্ডাবাড়ি, কঞ্চিপাড়া, উদাখালী, গজারিয়া, ফজলুপুর, উড়িয়া, এবং সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা ও হলদিয়া।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, রোববার বিকাল ৩টায় জেলার ফুলছড়ির তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রায়হান দোলন বলেন, “বাঁধে আশ্রয় নেওয়া পরিবার গুলোর সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর রাখছি। বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যার সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান জানান, বন্যার পানিতে জেলায় ৮৫০ হেক্টর জমির পাট, আমন ধানের বীজতলা, শাক-সবজি ও আউশ ধানসহ রবি ফসল নিমজ্জিত হয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিশ আলী বলেন, “এ পর্যন্ত ৪০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২ লাখ টাকা বন্যাকবলিত চার উপজেলায় বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্ব-স্ব উপজেলাগুলো ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এসব বিতরণ করবে। রোববার বিকালে নতুন করে ৬০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি, যা পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ দেওয়া হবে।”

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, উজানের ঢল ও টানা বর্ষণে জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। যমুনা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। জেলার ২০টি ইউনিয়নের ১ লাখ ২১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বন্যায় দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর উপজেলায় ১১২টি বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পানি ঢুকেছে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদেও।

যমুনা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, দশানী, জিঞ্জিরাম ও ঝিনাইসহ অন্যান্য শাখা নদ-নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এতে পানি ছড়িয়ে পড়ছে নিম্মাঞ্চলে। ডুবে গেছে বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজপাঠক আব্দুল মান্নান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েছে ৩৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

“ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ বসতবাড়ি ছেড়ে ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে উচু বাঁধ, সড়ক, সেতুর উপর।”

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।

গত ২৪ ঘন্টায় যমুনার নদীর পানি ৩৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সকাল ৯টা থেকে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিরাজগঞ্জের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম রফিকুল ইসলাম।

এছাড়া সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পয়েন্টেও বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

পানি বৃদ্ধির ফলে বাঁধের অভ্যন্তরে থাকা নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। আগাম বন্যার পানি আসায় কৃষকদের কাউন, তিল, পাটসহ আবাদি জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশের বীজতলা।

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুরমা নদীর পানি আগের চেয়ে কমলেও বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কমেনি মানুষের দুর্ভোগ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ শহরের অনেক এলাকা থেকে কিছুটা পানি নেমেছে। শহরের আরপিননগর এলাকার রুজেল আহমদ বলেন, “আমাদের এলাকার মূল সড়ক উপছে সুরমা নদীর পানি বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছিল। সন্ধ্যায় অনেকের বাড়িঘর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। দ্রুত পানি না নামলে আমাদের দুর্ভোগ শেষ হবে না।”

শহরের কাজিরপন্টে এলাকার সাদিকুর রহমান স্বপন বলেন, “গত দুই দিন ধরে পানিবন্দি। আমাদের ঘরে এখনও পানি, তবে পানি অনেকটা নেমে গেছে। যদি এভাবে পানি কমতে থাকে তাহলে রাতের মধ্যে আশা করছি সব নেমে যাবে।”

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিবুর রহমান জানান, রোববার সকালে সুরমা পানি বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সন্ধ্যায় কমে ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।