বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

যদি কাগজে লেখো নাম…

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
নভেম্বর ১৭, ২০১৭

‘যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিড়ে যাবে/পাথরে লেখো নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে/হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে/হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে/প্রতিটি মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে।’

প্রবোধ চন্দ্র দে। ডাক নাম মান্না দে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীত শিল্পীদের একজন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ অজস্র ভাষায় তিনি ষাট বছরেরও অধিক সময় সঙ্গীত সাধনা করেছেন। বৈচিত্র্যের বিচারে হিন্দি গানের ভুবনেও সবর্কালের সেরা গায়কদের একজন তিনি। ২০১৩ সালের আজকের (২৪ অক্টোবর) এ দিনে উপমহাদেশের বিখ্যাত এই সঙ্গীতজ্ঞ ব্যাঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে মারা যান। মহান শিল্পীকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন মান্না দে। তার বাবার নাম পূর্ণ চন্দ্র দে ও মায়ের নাম মহামায়া দে। মান্না দে’র সঙ্গীতে যাত্রায় বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা ছিল। তারপর সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পান চাচা সঙ্গীতে বিশেষভাবে দক্ষ শিক্ষক কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র কাছ থেকে। তিনিই তাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছেন। কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে ও উস্তাদ দাবির খানের কাছ থেকে গানের শিক্ষা লাভ করেন তিনি।মান্না দে তার শিশু পাঠ গ্রহণ করেছেন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় সহপাঠীদেরকে গান শুনিয়ে তিনি আসর মাতাতেন। ওই সময়ে মান্না দে আন্তঃকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা শ্রেণিবিভাগে প্রথম হয়েছিলেন।

১৯৪২ সালে চাচা কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সঙ্গে তৎকালীন বোম্বে দেখতে আসেন। সেখানে শুরুতে তিনি চাচার সহকারী হিসেবে এবং পরে শচীন দেব বর্মণের অধীনে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি অন্যান্য স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন। এক সময় স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ করতে শুরু করেন। ওই সময় তিনি বিভিন্ন হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি উস্তাদ আমান আলি খান ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন।

১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে’র অভিষেক হয়। এতে সুরাইয়ার সঙ্গে একটি দ্বৈত সংগীতে কণ্ঠ দেন মান্না দে। গানটির সুরকার ছিলেন তার চাচা। ওই সময়ে গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৫০ সালে ‘মশাল’ ছবিতে শচীন দেব বর্মণের সুরে ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। গানটির কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ গানটি গান। আর এর মাধ্যমেই তিনি নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করেন এবং জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছ থেকে কদর পেতে থাকেন।

পরে মান্না দে ভীমসেন জোসি’র সঙ্গে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গান। এ ছাড়াও ‘শোলে’ সিনেমায় তিনি কিশোর কুমারের সঙ্গে ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহী তোড়েঙ্গে’ এবং ‘পডোসন’ সিনেমায় ‘এক চতুর নার’ গানটি গান।

মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ আরো বেশকিছু গীতিকারের সঙ্গে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ‘শঙ্খবেলা’ সিনেমায় ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ গান করেছেন। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ প্রায় ৩৫০০ গান গেয়েছেন। তার জনপ্রিয় বাংলা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে-কফি হাউজের সেই আড্ডাটা, আবার হবে তো দেখা, এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, যদি কাগজে লেখো নাম, সে আমার ছোট বোন, পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, কতদিন দেখিনি তোমায়, খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমি সারারাত, এ নদী এমন নদী, মাঝরাতে ঘুম, এই আছি বেশ, এই রাত যদি, কি এমন কথা, ক’ফোঁটা চোখের জল, দীপ ছিল শিখা ছিল, যদি হিমালয়-আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ ও শাওন রাতে।

১৯৫৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে বিয়ে করেন মান্না দে।তাদের সংসারে দুই মেয়ে শুরোমা ও সুমিতা। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে ব্যাঙ্গালুরুর কালিয়ানগর শহরে বাস করেন।এ ছাড়া তিনি কলকাতায়ও বাস করেছেন।

সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকার ১৯৭১ সালে তাকে ‘পদ্মশ্রী’, ২০০৫ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ২০০৯ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মাননায় অভিষিক্ত করে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ প্রদান করে। এ ছাড়াও তিনি ১৯৬৯ সালে হিন্দী চলচ্চিত্র ‘মেরে হুজুর’ ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার; শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ), ১৯৭১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র ‘নিশি পদ্মে’ ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)ও ১৯৮৮ সালে রেনেসাঁ সাংস্কৃতিক পরিষদ, ঢাকা থেকে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।

২০০৫ সালে আনন্দ প্রকাশনী থেকে বাংলাভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমরীজ কাম এলাইভ’, হিন্দীতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুদিত হয়েছে। ২০০৮ সালে তার জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র মুক্তি পায়।