জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বাড়ছেই
জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম শুধু বাড়ছেই। ওষুধ কিনতে গেলে সাধারণ মানুষের নাভিশ^াস অবস্থা। দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা ওষুধ প্রশাসনের নেই। অন্য দিকে ওষুধের দাম বেড়েছে এমন অভিযোগ ওষুধ কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি স্বীকার করে না। তবে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বিষয়ে ওয়াকিফহাল ব্যক্তিরা বলছেন, সংশোধিত ওষুধ নীতিই ওষুধের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে পরিবর্তন না হলে এত ঘন ঘন এবং অযৌক্তিকভাবে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়াতে পারত না।
ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় সব কোম্পানির মধ্যে একটি মতৈক্য আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি কোম্পানি কোনো ওষুধের দাম বাড়ালে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অন্যান্য কোম্পানি দাম বাড়িয়ে নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অন্যান্য কোম্পানির ওষুধের দাম বাড়ালে আমার কোম্পানির ওষুধের দামও বাড়াতে হয়। দাম কমিয়ে বিক্রি করলে অন্যদের চাপে থাকতে হয়। আবার ক্রেতারা মনে করেন কম দামি ওষুধ নি¤œমানের (সাবস্ট্যান্ডার্ড)। সে জন্য ক্রেতারা কিনতে চায় না। তিনি বলেন, সব সময় যে দাম বাড়াতে হয় এমন নয়, না বাড়ালেও চলে। এ প্রসঙ্গে তিনি দাম বাড়ানোর আরেকটি যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘দাম বাড়ালে কিছু বাড়তি মুনাফা হয়ে থাকে। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, টাকার তুলনায় ডলারের দাম বৃদ্ধি, প্যাকেজিং ও প্রিন্টিংয়ের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে ওষুধের দাম বাড়াতে হয়। লোকসান দিয়েতো আর ব্যবসায় করা যায় না।’
ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো: রুহুল আমিন জানান, ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ওষুধ প্রশাসনের কিছু করার নেই। নিয়ম অনুযায়ী ওষুধ কোম্পানি দাম প্রস্তাব করে আমরা তাদের কাগজপত্র দেখে শুধু অনুমোদন করে দিই। তবে ১১৭টি ‘অ্যাসেনশিয়াল’ ওষুধের দাম আমরা নির্ধারণ করে দিই, এসবের দাম বাড়েনি।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম শফিউজ্জামান জানান, তার জানা মতে কিছু দিনের মধ্যে কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে এটা খুবই নগণ্য এবং এটা বাড়ানো ছাড়া ওষুধ কোম্পানির কোনো গত্যন্তর ছিল না। ইতোমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে। ওষুধ কোম্পানিতে ‘হোয়াইট কালার প্রফেশনালরা’ কাজ করেন। সঙ্গত কারণে তাদের বেতন বাড়াতে হয়েছে। খরচ বাড়লে তা দাম বাড়িয়েই তুলতে হয়, কোম্পানিকে টিকে থাকতে হলে এটা করতেই হবে।
গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৮২ সালে যে ওষুধ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল সেখানে ওষুধ কোম্পানি ইচ্ছা মতো দাম বৃদ্ধি করতে পারত না। এখনতো ওষুধ কোম্পানিকে কিছু (১১৭টি অ্যাসেনশিয়াল ওষুধ) ছাড়া অন্যান্য ওষুধের দাম নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ফলে তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে সরকার দাম নির্ধারণ করত। সেখানে একটি ওষুধ উৎপাদন করতে যত ধরনের খরচ হতো এর থেকে ১০০ শতাংশ বেশি যোগ করে দাম নির্ধারণ করা হতো। তিনি বলেন, অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে প্রত্যেকটি ওষুধের মূল্য সব ধরনের খরচ বাদ দিয়ে ১০০ শতাংশ মুনাফা দিয়ে নির্ধারণ করা হতো। সে নিয়মটি এখন নেই, বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে এখন ওষুধ কোম্পানি ইচ্ছা মতো ওষুধের দাম ঠিক করে আর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তা অনুমোদন করে দেয়। তিনি বলেন, এতে বোঝা যায় এখন প্রতিটি ওষুধে যাবতীয় খরচের পরে ১০০ শতাংশের বেশি মুনাফা করে।
দাম বাড়ার ব্যাপারে একটি ওষুধ কোম্পানির কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা বিদেশে ওষুধ রফতানি করি। রফতানির কারণে অনেক ওষুধের দাম বাড়াতে হয়েছে। ধরুন বাংলাদেশে কোনো ওষুধের দাম এক টাকা। এই ওষুধটা বিদেশে বিক্রি করলে আমরা কি ২০ টাকা দাম ধরতে পারব? বরং এ দেশের ১০ টাকার ওষুধটিই বিদেশে ১৫ টাকা অথবা ২০ টাকা দাম ধরে বিক্রি করতে পারব। তিনি জানান, ওষুধ কোম্পানি হয়তো কিছু মুনাফা করছে কিন্তু তারা ওষুধ বিক্রি করে দেশে ডলার আনছে। সামনের দিনগুলোতে বিলিয়ন ডলার রফতানি করবে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
ঢাকার খুচরা ওষুধের দোকান পর্যবেক্ষণ করে বেশ কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ বিক্রেতারা। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দাম বেড়েছে ইনসুলিনের, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের, থাইরয়েডের ওষুধ, ব্যথা-বেদনা উপসমের ওষুধ, কফ সিরাপ, হাঁপানির ওষুধ ও ইনহেলারের, ক্যালসিয়াম, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, ক্যাফেইনযুক্ত প্যারাসিটামল, গোল্ড ভিটামিন, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্রেইন স্টিমোলেটিং ওষুধের।
সব কোম্পানির উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধের দাম বেড়েছে কমপক্ষে দুই থেকে তিন টাকা। বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপের প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম আট টাকা। ৩০ ট্যাবলেটের গোল্ড ভিটামিন বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। এর আগের দাম ছিল ১৮০ টাকা। ডায়বেটিসের মুখে খাওয়ার (টাইপ-২ ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট) ওষুধ কিছু দিন আগেও ৩০ থেকে ৬০ টাকায় এক পাতা পাওয়া যেত। এখন এগুলো কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকা থেকে ৮০ টাকায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি দামে। বিদেশী ইনসুলিন বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। দেশী ইনসুলিন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। দেশী ইনসুলিনের অবশ্য দাম বাড়েনি। থাইরয়েডের ট্যাবলেট দুই বছর আগে কেনা যেত প্রতিটি এক টাকায়। এখন কিনতে হয় দুই টাকায়। প্রতিটি ইনহেলার (স্টেরয়েডযুক্ত) ১০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়।
গ্যাস্ট্রিকের ওমিপ্রাজল বা ইসোমিপ্রজাল ইত্যাদি প্রতিটি ট্যাবলেট অথবা ক্যাপস্যুল এক টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়। দেড় টাকার রেনিটিডিন এখন কিনতে হয় আড়াই টাকায়। ২৩ টাকার কফ সিরাপ এখন কিনতে হয় ৪৫ টাকায়।
অ্যান্টিসেপটিক ও ডিসইনফেকট্যান্ট মলম কিছু দিন আগে ২৫ টাকায় পাওয়া যেত। এখন কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকা অথবা এর চেয়ে বেশি দামে। ৩২ টাকার গ্যাস্ট্রিকের সাসপেনশন এখন ৬০ টাকার বেশি দামে কিনতে হয়। ভিটামিন-ডি যুক্ত চার টাকার ক্যালসিয়াম এখন কিনতে হয় সাত থেকে আট টাকায়। ২৫ টাকা সেফিক্সিম এখন কিনতে হয় ৩৫ টাকায়। ৩০ টাকার এজিথ্রোমাইসিন এখন কিনতে হয় ৩৫ টাকায়। ১২ টাকা সিপ্রোফ্লোক্সাসিন এখন কিনতে হয় ১৫ টাকায়। ক্যাফেইনযুক্ত প্যারাসিটামলের প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম এখন আড়াই টাকা। এটা কিছু দিন আগেও পাওয়া যেত দুই টাকায়। এ ছাড়া দাম বেড়েছে খাবার স্যালাইনের, বিভিন্ন ধরনের নাক অথবা চোখের ড্রপের।
ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন ভোক্তারা। তারা এখন মিডিয়ার কাছে জানতে চান কেন ওষুধের দাম বেড়েছে অথবা বাড়ছে। প্রতিদিনই পাঠক জানতে চাচ্ছেন কেন দাম বাড়ছে? তাদের প্রশ্ন কি এমন হলো যে কয়েক বছর ধরে অস্বাভাবিক হারে দাম বেড়ে চলছে?