প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে তোলপাড়
‘আমি পুরোপুরি সুস্থ, বিচার বিভাগ নিয়ে শঙ্কিত’- অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ত্যাগের আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেয়া এমন বক্তব্যে তোলপাড় চলছে। রাজনীতি ও বিচারাঙ্গনসহ সব মহলে আলোচনার মূল বিষয় এখন প্রধান বিচারপতির শেষ বক্তব্য। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে আলোড়ন চলছে। অন্য দিকে বিদেশে যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতির অনমনীয় অবস্থানে বেশ বিপাকে পড়েছে সরকার। দেশের বাইরে গিয়ে প্রধান বিচারপতি সার্বিক বিষয় নিয়ে কী ধরনের মন্তব্য করেন তা নিয়েও শঙ্কিত সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় দলের উপদেষ্টামণ্ডলীকে সাথে নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যৌথ সভা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেখানে প্রধান বিচারপতির অবস্থান এবং তার দেয়া শেষ বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন ও আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ ১১টি অভিযোগ এনে বিবৃতি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। দেশে ফিরে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ সুদূরপরাহত বলে সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আইনমন্ত্রী আজ রোববার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার বক্তব্য জানাবেন। অন্য দিকে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে সরকার বিচারব্যবস্থা ধ্বংসের যে ষড়যন্ত্র করছে তা প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করছেন বিএনপি ও সরকারবিরোধী আইনজীবীরা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় এবং পর্যবেক্ষণকে সরকার বড় আঘাত হিসেবে দেখলেও এই মুহূর্তে আরো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিচারপতির সর্বশেষ বক্তব্য। সরকার এবং প্রধান বিচারপতির মুখোমুখি অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। এটিকে কেন্দ্র করে সরকারের লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষছেন অনেকে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ৩ জুলাই বিচারপতি অপসারণসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহালের পক্ষে মত দেন। এরপর ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যবেক্ষণসহ প্রকাশ করা হয়। এই রায় নিয়ে সরকার ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শুধু তা-ই নয়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় এবং পর্যবেক্ষণকে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে দেখেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। বিশেষ করে সব বিচারপতির সর্বসম্মত রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত ‘রাজনীতিতে ব্যক্তিবাদ’, সামরিক শাসন, ‘অপরিপক্ব সংসদ’, দুর্নীতি, সুশাসন, মুক্তিযুদ্ধ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনাকে সহজভাবে নেননি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তারা এটিকে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখেন।
সে জন্য প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। প্রধানমন্ত্রীসহ দল ও সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতা-মন্ত্রীরাও আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরব হন। তারা প্রধান বিচারপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে তার অপসারণও দাবি করেন। প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে জাতীয় সংসদেও সরব ছিলেন সংসদ সদস্যরা। বিশেষ করে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতিরও বৈঠক হয়। পাশাপাশি দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করেন সরকারপন্থী আইনজীবীরা।
অন্য দিকে রায় এবং পর্যবেক্ষণকে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে প্রধান বিচারপতির পক্ষে সরব থাকেন বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আইনজীবীরা। এমন পেক্ষাপটে নানা নাটকীয়তায় গত ২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অসুস্থতার কারণে এক মাসের ছুটির আবেদন করেছেন বলে জানায় আইন মন্ত্রণালয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষরসহ রাষ্ট্রপতি বরাবর ছুটির একটি আবেদনপত্রও গণমাধ্যমে তুলে ধরেন। পরদিন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রশাসনিক পূর্ণক্ষমতা ভোগ করবেন বলেও ঘোষণা দেয় সরকার।
তবে প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে রাজনীতি ও বিচারাঙ্গনে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন চলে। এরপর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি কাটাতে বিদেশে যাবেন বলে জানানো হয়। বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা এটিকে সরকারের নতুন ষড়যন্ত্র বলে দাবি করে। বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য জানতে পারছিলেন না কেউ। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির সাথে একাধিকবার দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে শুক্রবার রাতে প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময় বাসভবনের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে তিনি অল্প কথায় লিখিত আনুষ্ঠানিক বক্তব্য তুলে ধরেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি; কিন্তু ইদানীং একটি রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত।’
প্রধান বিচারপতির প্যাডে লেখা সেই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে।’
প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্য গত বেশ কিছুদিন ধরে চলা নাটকীয়তায় নতুন মাত্রা যোগ করে। তার বক্তব্যের পর ছুটির দরখাস্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যা সরকারকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, ‘ষোড়শ সংশোধনী ইস্যুতে নানা চেষ্টার পরও প্রধান বিচারপতিকে বাগে আনতে পারেনি সরকার। সেজন্য বিভিন্ন কৌশলে তাকে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা হয়। ছুটি ও বিদেশ যাওয়া ইস্যুতে গত কিছু দিন ধরে তার নীরবতায় সরকারও খানিকটা স্বস্তিতে ছিল। তবে শেষটা ভালো হলো না। বিদেশে যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি বোমা ফাটালেন। এর মাধ্যমে গত কিছুদিন ধরে দেয়া সরকারের সব বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করেছেন এস কে সিনহা, যা সরকারের জন্য চরম বিব্রতকর।’
দলের সম্পাদক মণ্ডলীর দুইজন সদস্য বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির বিদেশে চলে যাওয়া নিয়েও স্বস্তিতে নেই সরকার। কারণ যাওয়ার আগে দেশেই তিনি যে বোমা ফাটালেন বিদেশে বসে আবার কী রকম এটম ফাটান তা নিয়ে আমরা সত্যিই টেনশনে আছি।’
এক নেতা বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন আর বেশি দূরে নয়। এই মুহূর্তে বিচারাঙ্গন নিয়ে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। দেখা যাক পানি কত দূর গড়ায়।’