শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বর্মি বাহিনীর প্রথম টার্গেট আলেম ও হাফেজ

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭
news-image

মিয়ানমারের বুচিডংয়ের মনুপাড়ার খবির উদ্দিনের বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে ছেলেসন্তান সব হারিয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে একজন শেখ আহম্মেদ আলী ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেজ। আর নুরুল হাকিম ছিলেন আরবি শিক্ষিত মৌলভী। এই দুই সন্তানের কী অবস্থা জানেন না খবির উদ্দিন। শুধু দেখেছেন বর্মি বাহিনী ও মগরা তাদের ধরে নিয়ে গেছে। খবির উদ্দিন বলেন, বর্মি বাহিনী ও মগদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে সেখানকার হাফেজ এবং আলেমদের হত্যা করা। খবির উদ্দিন নিজের চোখে অন্তত পাঁচজন আলেমকে গলা কেটে ও গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন।

১৩ দিন হেঁটে গতকাল বুধবার খবির উদ্দিন পরিবারের অবশিষ্ট আট সদস্যকে নিয়ে পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে পৌঁছেন। গতকাল সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায় খবির উদ্দিনকে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই ছেলেকে তার চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে গেছে। পরিবারের নারী ও শিশু ছাড়া কেউ আর বেঁচে নেই। তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালেও মগদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিছু দিন পরে বাপদাদার ভিটেমাটিতে চলে গেছেন।
কিন্তু এবারের মতো করুণ পরিস্থিতি আর কোনো দিন দেখেননি। তিনি বলেন, এই বয়সে এসে ছেলেসন্তান হারিয়ে তাকে নিঃস্ব হতে হবে কোনো দিন চিন্তাও করেননি। চোখের সামনে দেখেছেন কিভাবে শত শত মানুষকে বর্মি বাহিনী ও মগরা হত্যা করেছে। পথে আসার সময় এক বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনে ভেতরে তাকিয়ে দেখেন মাস ছয়েকের একটি শিশু রক্তের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। পাশে পড়ে আছে নারী-পুরুষ এবং আরো কয়েকটি শিশুর লাশ।
ওই শিশুটিকে খবির উদ্দিন নিজেদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। এ দিকে সেখানকার আলেমদের হত্যার ব্যাপারে আরো অনেক রোহিঙ্গার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। মৌলভী ইউসুফ নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, তার ওস্তাত (শিক্ষক) তম্রু কোয়াইংচিবং মাদরাসার মাওলানা নুর আহম্মেদকে নামাজরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। তার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে বর্মি বাহিনী ও মগরা। মৌলভী ইউসুফ বলেন, কোনো আলেম ওলামাকে তারা আর বাঁচিয়ে রাখেনি। কোনো কোনো আলেমকে হাত-পা কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে।
সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে চলে আসবে!
মিয়ানমারের রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে শরণার্থীর সংখ্যা এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ।
ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনার ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বলছে, চলতি সংকটের সবচেয়ে খারাপ দিক হতে পারে এটাই যে, মিয়ানমার থেকে সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। সংস্থা দুটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো দ্রুততার সাথে সহায়তায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার একজন পরিচালক মোহাম্মেদ আবদেকার মোহামুদ ও ইউএনএইচসিআর -এর সহকারী হাই কমিশনার জর্জ অকোথ অব্বুর নেতৃত্বাধীন যৌথ দল সম্প্রতি কক্সবাজারে শরণার্থী পরিস্থিতি দেখে এসেছেন।
বৃহস্পতিবার ওই সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছেন, শরণার্থী সংখ্যা এখন চার লাখ এবং প্রতিদিন ১০-২০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকছে। নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নিচ্ছে ১০-২০ হাজার করে রোহিঙ্গা।
তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা সোজা করে বলেছেন, বাংলাদেশ গভীর মানবিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে। একই সাথে তারা বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন নিজেদের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
তারা বলেছেন, যে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে তারা দুটো ধারণা করছেন- একটি হল যে পরিস্থিতি ভালো হবে যদি আর কেউ বাংলাদেশে না আসে, কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ বা খারাপ দিক যেটি হতে পারে তা হলো এমন অবস্থা চললে সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে চলে আসতে পারে।
ইউএনএইচসিআর -এর সহকারী হাই কমিশনার জর্জ অকোথ অব্বুর রীতিমত উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেছেন, মাত্র আড়াই সপ্তাহে চার লাখ রোহিঙ্গা এসেছে, এটা অনেক বড় একটি সংখ্যা। সে কারণেই এ বিষয়ে এখন অনেক কিছু করণীয় আছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিপর্যয়কর মানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন।
রাখাইনে চলমান সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সেখানে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে দেশটির কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।
এর আগে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরী বৈঠকে বসে। বৈঠকে নিন্দা জানানোর পাশাপাশি সেখানে সেনা অভিযান বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বানও জানানো হয়।
কিন্তু তাতে ঠিক কতটুকু সাড়া মিলছে?
জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তারা বলেছেন, যে সহায়তা আসছে তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসা উচিত। কাল করবো, পরশু করবো এমন ভাবলে চলবে না, আজই করতে হবে, আজই এগিয়ে আসতে হবে সহায়তা নিয়ে। এখানকার সরকার ও জনগণ তাদের সাধ্যমত করছে কিন্তু এগিয়ে আসতে হবে বিশ্ব সম্প্রদায়কেই।
এই কর্মকর্তারা বলছেন, হুট করে এতো শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসবে সেটা শুরুতে তারা বুঝতে পারেননি। এখন অনেক কিছুই করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
সেজন্য খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় সুবিধা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। শরণার্থী সংখ্যা তিন লাখ হওয়ার পর জাতিসঙ্ঘ ৭৭ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার কথা বলেছিল এখন সেটি চার লাখ পার হওয়ায় এবং আরও বিপুল সংখ্যক শরণার্থী পথে থাকায় কী পরিমাণ সহায়তা লাগতে পারে সেটি নতুন করে নির্ধারণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
জাতিসঙ্ঘে আট লাখ রোহিঙ্গার জন্য মানবিক সহায়তা চাইবে বাংলাদেশ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে আগামী শনিবার নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। এই অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নতুন চার লাখ এবং আগে থেকে থাকা চার লাখ, অর্থাৎ মোট আট লাখ রোহিঙ্গার জন্য মানবিক সহায়তা চাইবেন। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর জাতিগত নির্মূল অভিযান বন্ধ এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাইবেন। সীমান্ত অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশের জন্য একটি সঙ্কট হয়ে দেখা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়া উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এ সব কথা জানিয়েছেন। এতে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকসহ মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও অতিমাত্রায় বল প্রয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ ও নিন্দা জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ গতকাল যে বিবৃতি দিয়েছে, বাংলাদেশ তাকে স্বাগত জানায়। নিরাপত্তা পরিষদের এ অবস্থান খুবই সময় উপযোগী ও দৃঢ়। বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে এ ধরনেরই একটি অবস্থান আশা করছিল।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে প্রস্তাব মিয়ানমার প্রত্যাখান করেছে – এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মাহমুদ আলী বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর অং সান সু চি জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তার দফতরের একজন মন্ত্রীর সাথে নিউইয়র্কে আমার কথা হবে। সে সময় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ থাকবে।
জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে যোগ দেয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।