শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন আতঙ্ক!

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭
news-image

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখায় মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী মাইন পেতে রাখছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ।

মিয়ানমার সরকার সে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে নিজেদের জড়াচ্ছে।
সীমান্তে পুঁতে রাখা বোমার (ইমপ্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি) কারণে গণহত্যার কবল থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসা রোহিঙ্গারা প্রাণ হারাচ্ছে। নিরাপদ নয় সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও।

এ ঘটনায় সীমান্ত জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। ইতোমধ্যে গত একসপ্তাহে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের আশারতলীর বড় শনখোলা, ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার বাহিনীর পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে পাঁচজন রোহিঙ্গা ও একজন বাংলাদেশি মারা গেছে। আহত হয়েছে অর্ধশত মানুষ।

স্থানীয় সূত্র জানায়, দু’সপ্তাহ আগে সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদেরে বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান ও সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত- নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের আশারতলী ও চাকঢালা সীমান্তের সাপমারাঝিরি বড় শনখোলা, নিকুঞ্জছড়ি, চেরারমাঠ, রাবারবাগান, প্রধানঝিরি এবং ফুলতলী- এই ছয় স্থানে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম, তুমব্রু, জলপাইতলী, রেজু, আমতলী, বাইশফাঁড়ীর পাশাপাশি দোছড়ি ইউনিয়নের লেম্বুছড়ি সীমান্তেও আশ্রয় নিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা। প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ এখনো থেমে নেই। অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গারা যাতে ফের মিয়ানমারে প্রবেশ করতে না পারে- সে জন্য সীমান্তের শূন্যরেখায় মাইন পাতছে মিয়ানমার বাহিনী।

মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাও বলছে, মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর নিষিদ্ধ এ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন পেতে রেখেছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে। এ ধরনের মাইন যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু মানুষ নিধনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইন থেকে আলাদা। মানুষের পায়ের চাপ পড়লেই মাটিতে পুঁতে রাখা এ মাইন বিস্ফোরিত হয়।

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ঠেকাতে ঘুমধুম থেকে আলীকদম সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার অংশে সহস্রাধিক স্থলমাইন ও উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরক পুঁতে রেখেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এসব মাইন বিস্ফোরণে প্রতিদিনই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে নাইক্ষ্যংছড়ির আদর্শগ্রামের বাসিন্দা বদিউল আলমের ছেলে হাশিম উল্লাহ, মিয়ানমারের সৈয়দ আহমদ, মোক্তার আহমদ ও গোল চেহের বেগমসহ ছয় জন মৃত্যুবরণ করেছে। এই আতঙ্ক এখন সীমান্তের সাধারণ মানুষকেও ভোগাচ্ছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের মাইন স্থাপনের ঘটনায় বিজিবি কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানালেও এখনো মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কোন উত্তর নেয়নি। বরং নতুন নতুন এলাকায় শত শত স্থলমাইন পাতছে সে দেশের সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে মৃত্যুর চরম ঝুঁকি নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে এখনো ঢুকছে শত শত রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানান, ওপারে নিবর্বিচারে গুলি ও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি সীমান্তে মাইন পুঁতে নতুন কৌশলে রোহিঙ্গা দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। নির্যাতন সইতে না পেরে এপারে পালিয়ে এসেও রক্ষা পাচ্ছে না রোহিঙ্গারা। কাঁটাতারের পাশে শত শত স্থলমাইন ও বিস্ফোরক থাকা সত্ত্বেও জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে। অন্যদিকে প্রতিনিয়িত মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গা ও সীমান্তের বাসিন্দারা।

চাকঢালা সীমান্তের বড় শনখোলায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নুর মুহাম্মদ বলেন, সীমান্তে শুধু কাঁটাতারের বেড়া নয়, যেসব জায়গা দিয়ে মানুষ চলাচল করে এবং রোহিঙ্গারা যেসব রাস্তা ধরে বাংলাদেশে আসছে সেসব জায়গাগুলোতে মাইন ও বিস্ফোরক পুঁতে রাখা হয়েছে।

ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে আশ্রয় নেয়া মাইন বিস্ফোরণে আহত- মিয়ানমারের ফকিরা বাজার এলাকার রোহিঙ্গা আক্তার আহম্মদ জানান, মাইন বিস্ফোরণে যারা আহত হচ্ছে তাদের শরীরের বেশিরভাগই উড়ে যায়। বিস্ফোরকে আহতরা মারা না গেলেও পঙ্গু হয়ে যায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শুধু এখন নয় এর আগেও দু’দেশের শূন্যরেখায় অসংখ্য মাইন পুঁতেছে। রাঁতের আধারে এমনকি টহলের সময়ে তারা দল বেঁধে মাইন পাতছে। দূর থেকে মাইন পুঁতে রাখার দৃশ্য দেখা গেলেও ভয়ে কাছে কেউ যায় না।

ঢেকুবনিয়া এলাকার জনপ্রতিনিধি নুর মোহাম্মদ বলেন, আগে নাসাকা ক্যাম্পগুলোতে বিস্ফোরক বানানো হতো। এখন এসব আরও উন্নত করা হয়েছে। এ কারণে হতাহতের ঘটনাও বেশি ঘটছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, শূন্যরেখায় বিপুল সংখ্যক মাইন থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারসহ এপারে আসছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে থাকা রোহিঙ্গা সুযোগ বুঝে তাদের বাসা বাড়িতে ফিরতে গিয়ে মাইনে আহত হচ্ছে। এছাড়া গরু-ছাগল ও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতরা লোভে পড়ে জিরো লাইনে কাটা তারের বেড়া অতিক্রম করতে গিয়ে বিস্ফোরণে আহত হচ্ছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি বিস্ফোরককে ইমপ্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি বলা হয়ে থাকে। এগুলো বাঁশ বা লোহার নলের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে, তার জোড়া দিয়ে বানানো হয়। অনেকটা মাইনের আদলে। এতে পা পড়লে বা আঘাত লাগলে তা বিস্ফোরিত হয়। অপর দিকে চীন ও রাশিয়ার তৈরি কিছু এন্টি পারসোনাল মাইন বা স্থলমাইনও মাটিতে পুঁতে রাখা হচ্ছে।

বিজিবি কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার ও নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো.আনোয়ারুল আযীম বলেন, যেহেতু ঘটনাগুলো সীমান্তের ওপারে ঘটছে- সে জন্য স্পষ্ট করে বলতে পারছি না, এসব মাইন না বিস্ফোরক। তবে লোকজন আহত ও নিহত হওয়ায় এগুলো যে উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরক তা বুঝা যাচ্ছে। বিজিবির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত চার বার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার বাহিনীর সাড়া পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য-৯০ এর দশকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন সীমান্তে স্থলমাইন বসায়। পরে রোহিঙ্গা সমস্যা বাড়লে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় সেদেশের সেনাবাহিনী স্থলমাইন বসায়। এসব মাইন অপসারণে দু’দেশের বাহিনী বেশ কিছু অভিযানও পরিচালনা করেছে। তবে সীমান্ত সমস্যার কারণে মাইন অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।