রাজধানীতে নতুন খাল খনন হচ্ছে, সংরক্ষণ হবে পুরনোগুলো
বৃষ্টির পানি নিষ্কাষণে রাজধানীতে অপর্যাপ্ত খালের কারণে ভোগান্তির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, পুরনো খাল সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন নতুন খাল খনন করা হচ্ছে। শহরে জলাধারগুলো সংরক্ষণেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার রাজধানীতে ২৭টি দেশের অংশগ্রহণে দুই দিনের ‘ঢাকা পানি সম্মেলন’ এর উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা জানান। এ সময় তিনি নগরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আমূল পাল্টে দেয়ার কথাও বলেন। জানান, চার বছরের মধ্যে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে সরবরাহ বন্ধ করা হবে। ভূ উপরিস্থ পানিই ব্যবহার করা হবে শতভাগ।
রাজধানীতে পানি নিষ্কাষণে ২৬টি খাল থাকলেও এর মধ্যে ১৩টির কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। সরকারি, বেসরকারি স্থাপনা তৈরি করে খালগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেই তৈরি হয় জলজট। সম্প্রতি এই ভোগান্তির পর খালের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় নতুন খাল খনন করা হচ্ছে এবং পুরাতন খাল সংস্কার ও জলাধার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিল্পাঞ্চল, বড় বড় আবাসিক এলাকায় জলাধার তৈরি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, দূষিত পানি নিষ্কাষণেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’
‘বাংলাদেশ বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় এই অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনা বিশ্বের অন্যান্য এলাক থেকে একটু ভিন্ন’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী সমতল, পাহাড় ও উপকূলীয় এলাকাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়েছে বলে জানান।
রাজধানীসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি তোলা চার বছরের মধ্যে বন্ধ করে দেয়ার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে সব বিভাগীয় শহরে নিরাপদ পানি ভূ উপরিস্থ পানি থেকে নিশ্চিত করার কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি। নাব্যতা হ্রাস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে।’
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে সরবরাহ করা পানির বেশিরভাগই মাটির নীচ থেকে তোলা হচ্ছে। এতে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে এই ক্ষতি কিছুটা পূরণ হলেও বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কংক্রিটের কারণে পানির নিচে পানি খুব বেশি যেতে পারে না। ফলে ঢাকায় মাটির নিচে ফাঁপা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই পরিস্থিতিতে মাটির নিচ থেকে পানি তোলা বন্ধে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী শিল্প বর্জ্যে দূষিত হয়ে যাওয়ায় দূষণ দূরীকরণের পাশাপাশি পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে পানি এনে তা রাজধানীতে সরবরাহের কাজ এগিয়ে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ভূগর্ভস্থ পানির বদলে ভূ উপরস্থ পানি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি।’
পানি ব্যবস্থাপনার দিক থেকে বাংলাদেশে মূল সমস্যা হিসেবে আর্সেনিক, লবণাক্ততা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, ভূ উপরিস্থ পানি সংরক্ষণে অপ্রতুলতা, পানি সংরক্ষণ ও শিল্প বর্জ্যসহ নানা কারণে পানি দূষণকে চিহ্নিত করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে আমরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কার্যকর করে যাচ্ছি।’
পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ১০০ বছর মেয়াদী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লবণাক্ত পানিপ্রবণ এলাকায় পুকুরের পানি ফিল্টার করে লবণাক্ততামুক্ত করা হয়েছে। সাত হাজার পুকুর খনন ও গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে ৩২ হাজার ৬০০টি। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ৩২ হাজার চারশটি জলাধার সংরক্ষণ করা হয়েছে।’
সারা বিশ্বে ১৬০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভূগছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আমাদের সরকার ইতিমধ্যে বিশেষ সাফল্যের সাক্ষর রেখেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৮৪ শতাংশ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এসেছে ৮৭ শতাংশ মানুষ। শহর এলাকায় শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে শতকরা ৯৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাষণ সুবিধার আওতায় এসেছে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারও সঙ্গে বৈরীতা নয়’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েও নিয়েও নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা নিয়েও আমাদের নজর দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বে এই মুহূর্তে ২.৪ বিলিয়ন মানুষ স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া নিরাপদ পানির অভাবে পৃথিবীতে এক মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে, যাদের অধিকাংশই শিশু। প্রতিদিন বিশ্বে গড়ে এক হাজার শিশু বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রাণ হারায়। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি আগেও তুলে ধরেছি।’
এসডিজি বাস্তবায়নে সাফল্য
সম্মেলনে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এসডিজি বাস্তবায়নে বিশ্বে রোল মডেল হয়ে উঠেছে।’
‘দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালে যেখানে ৪১.৫ ভাগ ছিল তা আমরা কমিয়ে ২৩.২ ভাগে নিয়ে এসেছি। আয় বৈষম্য হ্রাস, স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম কমানো এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষ সমতা অর্জনে আমরা বিশেষ সাফল্য লাভ করেছি।’
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ১৫.৪ শতাংশ থেকে কমে ৪.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ছাড়া মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অন্তর্ভুক্তি, নারীর ক্ষমতায়নসহ অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।’
এসডিজি নির্ধারিত সময় সীমা ২০৩০ সালের আগেই সরকার শতভাগ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।