ঘরে ঘরে অসংখ্য তসলিমা নাসরিন চাই
জেসমিন চৌধুরী : তসলিমা নাসরিন একসময় লেখার মাধ্যমে একের পর এক বোমশেল ফাটিয়েছিলেন। পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার মতই সত্য সব কথাবার্তা বলেছেন, যা অধিকাংশের পক্ষে মেনেও নেওয়া যায় না, আবার ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যার অনেকটুকুকেই সত্যি বলে অস্বীকার করার উপায় থাকে না, যে কথাগুলো অমন করে আগে বা পরে কেউ বলার সাহস দেখাতে পারেনি।
যাদের চিন্তার ক্ষমতা আছে তারা তসলিমার কথাগুলো বুঝতে পেরেও তাকে মেনে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বলে, ‘তসলিমার সবই ভালো, শুধু ধর্ম নিয়ে অহেতুক কথাবার্তাগুলো না বললেই পারতেন’। অনেকে আবার বলেন ‘এদেশে মৌলবাদকে উস্কে দেওয়ার পেছনে তার ভূমিকা এতোই বিশাল যে তার লেখা উপকারের চেয়ে অপকার করেছে বেশি’। অনেকে বলেন ‘তিনি লেখার মাধ্যমে মূলত নিজের ওপরে ফোকাস আনার চেষ্টা করেছেন তাই তার বলা কথাগুলোর চেয়ে তার কৃত কাজগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক বেশি’। অনেকে বলেন, ‘বেগম রোকেয়াও তো সমাজ পরিবর্তনে নেমেছিলেন, কই তিনি তো ধর্ম নিয়ে কিছু বলেননি’।
ওপরের কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে কিছুদিন আগে কয়েকজন শিক্ষিত চিন্তাশীল পুরুষের সাথে তসলিমা বিষয়ে এক ড্রয়িংরুম আলোচনা থেকে এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ে আমার একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে বিভিন্ন নারী পুরুষদের মন্তব্য থেকে। তসলিমাকে নিয়ে এই আলোচনার সারমর্ম হচ্ছে, ‘তিনি সাহসী এবং তার লেখার বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে বিবেচনার দাবি রাখে, কিন্তু তিনি একজন ফেইম সিকার যে নিজের লেখার বিষয়বস্তু থেকে নিজেকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে ধরেছেন এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে ধর্মকে আক্রমণ করেছেন শুধুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য’।
তসলিমার সাথে আমার পরিচয় মূলত তাকে নিয়ে আমার পরিচিতজনদের সমালোচনার মাধ্যমে। তিনি যখন লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও খ্যাতি লাভ করেন সেই সময়টায় আমি ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত ছিলাম বিধায় তার লেখা আমার খুব একটা পড়া হয়নি কিন্তু তাকে নিয়ে সমালোচনা যত শুনেছি, ততই তার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়েছে। আমি তসলিমার ভক্তও না, তাই এসব কথা শুনে একমত পোষণ না করলেও আমি খুব একটা প্রতিবাদমুখরও হয়ে ওঠি না।
কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নারী পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যের অভিজ্ঞতা এবং এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা থেকে আমি বুঝতে পারি তসলিমা কেন বেগম রোকেয়া না হয়ে তসলিমা হয়েছেন, আমারও কেন তসলিমা হওয়া উচিৎ ছিল, কেন বাংলার প্রতিটি নারীর তসলিমা হওয়া উচিৎ আর কেনইবা তসলিমা নামটির উচ্চারণও আপনাদের জন্য বিছুটি পাতার সংস্পর্শ সদৃশ যন্ত্রণাদায়ক।
বেগম রোকেয়ার সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নারীর সামাজিক অবস্থানে অনেক পরিবর্তন এসেছে সত্যি, কিন্তু নারীমুক্তির মক্কা এখনও অনেক দূর। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রয়োজন দেখা দিয়েছে ভিন্ন ধরনের আন্দোলনের। বেগম রোকেয়ার মতো নারীরা মুক্তির যে ধাপে নারী সমাজকে তুলে দিয়ে গেছেন, আপনারা হয়ত চান নারী সেই ধাপেই বসে থাকুক অনন্তকাল, কিন্তু আমরা সবগুলো ধাপই বেয়ে উঠতে চাই। এবং পরবর্তী ধাপগুলোতে উত্তরনের জন্য নারীকে আরো দুর্বার, আরো আরো গতিময় হতেই হবে। তসলিমাদের প্রয়োজন এখানেই।
বেগম রোকেয়া লড়েছিলেন নারীর শিক্ষার অধিকারের জন্য। আজ নারীশিক্ষার প্রয়োজনের কথা যদিও তাত্ত্বিকভাবে সর্বস্বীকৃত একটা ব্যাপার, বিশ্বজুড়ে এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন আজো সম্ভব হয়নি, এবং এই হতে না পারার পেছনের কারণগুলো নিয়ে লড়তে গিয়েই নারীকে আরো অনেক কিছুর বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। কান টানলে মাথা আসবেই। নারী অধিকারের কথা বলতে গেলেই সমাজ, সংসার, ধর্মের কথা অবধারিতভাবে ওঠে আসে। তসলিমা নাসরিনদের জন্ম ঘটে সেজন্যই। মুচকি হেসে ফুল ছিটিয়ে বড় কোনও পরিবর্তন কখনও আসেনি, আসবেও না।
আমাদেরকে বলা হয় সুন্দরভাবে আন্দোলন করতে, ভাষার সৌন্দর্য রক্ষা করতে, প্রচলিত কোনও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা না বলতে। কিন্তু আমরা যেসব মেয়েরা ভাবতে শিখেছি, নারীকে খাটো করে রাখা প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস আর সামাজিক প্রথাগুলো আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কী পরিমাণ কষ্ট দেয় তা বিবেচনা করে দেখলে বুঝতে পারতেন কেন আমরা প্রায়ই ক্ষেপে যাই। আমাদের জায়গায় থাকলে হয়তো আপনিও ততটাই ক্ষেপতেন।
নারী আর পুরুষ- নাক, কান, হাত, পা, মগজ নিয়ে দু’জনেই মানুষ কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তাদের যৌনাঙ্গের গঠন ও ব্যবহারের ধরন ভিন্ন। উভয়েই মানুষ হওয়া সত্ত্বেও শারীরিক কিছু গঠনের কারণে তাদের কাজকর্মের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে যা মোটেই আমাদের আন্দোলনের বিষয় নয়। পুরুষ চাইলে ধর্ষণ করতে পারে, নারী পারে না। পুরুষ পথের পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে পারে, নারী পারে না। সেরকম জরুরি অবস্থা দেখা দিলে তাকে বসতে হয়, এবং তখন সেটাকে অশোভন ভাবা হয়। তসলিমা তার কোনও লেখায় নারীর পথের পাশে বসে প্রস্রাব করার অধিকারের দাবি জানিয়েছেন কিনা আমি জানি না। আমি নিজে এই দাবি জানাই না। পথের পাশে বসে প্রস্রাব করে পরিবেশ দূষণে পুরুষের সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। বরং আমার দাবি হচ্ছে সর্বত্র মূত্রালয়ের ব্যবস্থা করা হোক যাতে সকলেই সভ্য ভাবে কাজটি করতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে শোভন/অশোভনের হিসেবটাতে আমার ঘোর আপত্তি রয়েছে। প্রয়োজনেও নারীর পথের পাশে বসে পড়াটা অশোভন, এই ধারণার উৎপত্তি কোথায়? পুরুষ নারীকে অনাবৃত অবস্থায় দেখলে নিজের কামলিপ্সা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কাজেই জরুরি প্রয়োজনেও একজন নারীকে আড়াল আবডাল খুঁজতেই হবে, এবং তা না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নিজের কিডনির বারোটা বাজিয়ে হলেও। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট- নারী ভোগের সামগ্রী এবং পুরুষ ভোক্তা। তা না হলে বিষয়টা উভয়ের জন্য সমান হবে না কেন? যা নারীর জন্য অশোভন তা পুরুষের জন্য অশোভন নয় কেন? মেয়েদের পথের পাশে বসাকে আপনি যতটা অশোভন ভাবেন, আপনার এই ভাবনার পেছনের কারণটা আমার কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি অশোভন।
বেগম রোকেয়া সমাজকে মেনে নিয়ে সমাজের ভেতরে বসে সমাজকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আপনারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ কী জানেন? তিনি যেটুকু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তাতে করে আপনাকে এক মিলিমিটার স্থানও নারীকে ছেড়ে দিতে হয়নি তাই আপনি খুশি ছিলেন। আজ নারী তার অবস্থানের পুরোটা অধিকার চাইছে, তাই আপনার ভালো লাগছে না। কিন্তু আপনার ভালো লাগা না লাগায় আমার কী আসে যায়? আমি কোণে বসে কাটিয়েছি হাজার বছর, এবার আপনার পালা। আমার অবস্থানে এসে কয়েকটি দিন কাটিয়ে দেখুন, বুঝে যাবেন খারাপ লাগা কাকে বলে।
একটা অল্প বয়েসী মেয়ে সেদিন ইনবক্সে মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘এমন একটা বই লিখতে পারেন না যেটা পড়ে মানুষের ব্রেইন ওয়াশ হয়ে যাবে? যেটা পড়ে তারা মেয়েদেরকে আর ছোট ভাববে না?’ মেসেজটা পড়ে খুব মন খারাপ হলো। একটা সতেরো আঠারো বছরের মেয়েকে, যার এই বয়সে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটার কথা, কেন এখন এসব কথা তার ভাবতে হয়? জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে ছোট করে রাখা না হলে সে কেন একজন অপরিচিত লেখককে এমন প্রশ্ন করে? কোনও ছেলেকে তো কখনও এই প্রশ্ন করতে শুনিনি।
আমি চাই ওই মেয়েটিও তসলিমা নাসরিনের মতো দুরন্ত হবে, কথা বলার সাহস দেখাবে। আমি চাই বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে হবে তসলিমা নাসরিনের মত অপ্রতিরোধ্য। যে মুখ তাকে নারী হিসেবে ছোট করতে চাইবে, সেই মুখ সে থেঁতলে দেবে। শোভন/অশোভনের হিসাবের যাঁতাকলে নিজের অধিকারকে, মর্যাদাকে বিসর্জন দেবে না। বিনিময়ে হয়তো অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনতে হবে তাকে, তবু সে তার নায্য পাওনার জন্য সাহসের সাথে লড়ে যাবে। প্রয়োজনে গৃহহারা হবে তবু বলে যাবে, ‘এই ঘরের অর্ধেকটা আমার ছিল, তুই জোর করে নিয়েছিস। তুই লম্পট। আমি নই, তুই ছোট, আমার থেকে অনেক ছোট’।
লেখক: অভিবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক