শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘আমার কথাগুলো এলোমেলো, গুছিয়ে নেবেন’

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
জুলাই ১, ২০১৭
news-image

‘আমরা কখনও ভাবিই না যে ইশরাত নেই। আমাদের মনে হয় সবসময়ই ও আমাদের সঙ্গে আছে। হয়তো দেখতে পাচ্ছি না, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারছি না বোনটাকে। কিন্তু কোথাও না কোথাও সে আছে, ভালোই আছে— এটা ধরে নিয়েই জীবন চালাচ্ছি। এতে করে আমাদের বেঁচে থাকাটা সহজ হয়।’

থেমে থেমে কথাগুলো বলছিলেন গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ইশরাত আখন্দের ভাই এম এ ইউসুফ আখন্দ। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘এগুলো খুব ব্যক্তিগত অনুভূতি, গুছিয়ে বলার মতো না। তাই আমার কথাগুলো খুব এলোমেলো, আপনি প্লিজ গুছিয়ে নেবেন।’

 

হলি আর্টিজান বেকারির ওই জঙ্গি হামলায় নিহত হন ২০ জন। তাদেরই একজন ইশরাত আখন্দ। জেডএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ছিলেন তিনি। এর আগে গ্রামীণফোন ও ওয়েস্টিন হোটেলের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন তিনি। বিজিএমইএ’র সাবেক মানবসম্পদ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

 

বৃহস্পতিবার উত্তরায় ইউসুফ আখন্দের বাসায় বসে কথা হয় তার ও তার মা আছিয়া খাতুনের সঙ্গে। ইউসুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই বাসার যেখানে চোখ রাখবেন সেখানেই ওর কিছু না কিছু পাবেন। ড্রয়িং রুমের ভেতরে দরোজার পাশেই দেখবেন একটি কির্বোড। ইশরাত বাজাত। দেয়ালের দুই পাশে আছে বড় বড় দু’টি পেইন্টিং। ওগুলো ইশরাতের হাতে আঁকা। সোফার পাশে রাখা সাইডল্যাম্পটাও ইশরাতের। পুরো বাসাজুড়ে সবই ইশরাতের স্মৃতিঘেরা।’

কিছুটা বিরতি দিয়ে ইউসুফ বলতে থাকেন, ‘এমন একটি হামলায় নিহত হওয়া বোনকে কেমন করে ভুলে থাকব! কিন্তু বেঁচে তো থাকতেই হয়। চলতে হবে, তাই চলছি; এর চেয়ে বেশিকিছু নয়।’ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কী আর বলার আছে! এগুলো তো খুবই ইমোশনাল আর ব্যক্তিগত বিষয়।’

 

ইউসুফ বলতে থাকেন, ‘আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে দুই ভাই আগেই মারা গিয়েছেন। ইশরাত ছিল আমার সাত বছরের ছোট। তবু পিঠাপিঠি ভাইবোন হিসেবে আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনেক অন্তরঙ্গ, মধুর।’ ওই দিনের পর থেকে ৮৫ বছর বয়সী মা আছিয়া খাতুন প্রতিদিন কান্না করেন বলে জানান ইউসুফ।

 

সেদিনের ঘটনা কখন জানতে পারলেন— জানতে চাইলে ইশরাতের ভাই বলেন, ‘গুলশানে কিছু একটা হয়েছে শুনে আমি আর মা ওকে ফোন করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ফোনে পাইনি ওকে। পরদিন সকালে আত্মীয়দের মাধ্যমে জানতে পারি ইশরাতের কথা।’

এরই মধ্যে ড্রয়িংরুমে ইশরাতের আঁকা পেইন্টিংয়ের সামনের সোফায় বসলেন তার মা। ইউসুফ আখন্দ এ প্রতিবেদককে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই মুখে কাপড় চেপে আছিয়া খাতুন বলেন, ‘বলার তো কিছুই নাই রে মা! সন্তান হারানোর যে কষ্ট, তার মতো কষ্ট দুনিয়ায় আর নাই।’

 

একটু সময় নিয়ে আছিয়া খাতুন বলেন, ‘মেয়েটা খুব আদরের ছিল। সবাই ওকে আদর করত। সেই মেয়েটা আমার চলে গেল। এই কষ্ট বোঝানোর কোনও ভাষা নেই। মেয়ের অভাব তো কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। আমার মেয়েটা খুব গুণী, বুদ্ধিমতী আর সাহসী ছিল। আল্লাহ ভালো জানেন, কেন সেই মেয়েটাকেই আমার হারাতে হলো। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সান্ত্বনা দিয়ে কী করব, আমার মেয়েকে তো আর কোনোকিছু দিয়েই ফেরত পাবো না।’ তবে তিন-চারটা ছেলে এত অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকলো, অথচ কেউ তাদের দেখলো না কেন— সেই প্রশ্নটাই আবার তুলে ধরেন তিনি।

গাজীপুরে নিজের কর্মস্থলের পাশে ইশরাতকে দাফন করেছেন জানিয়ে ইউসুফ বলেন, ‘বোনটাকে আমার কাছেই রেখে দিয়েছি, কবর দিয়েছি আমার অফিসের পাশেই। ইচ্ছা হলেই সেখানে যাই। এভাবেই ইশরাত আমাদের সঙ্গে আছে। ও নেই, এটা আমরা কখনই ভাবি না। এতে আমাদেরও বেঁচে থাকতে সুবিধা হয়। আমাদের বিশ্বাস, ও যেখানেই আছে ভালো আছে। কারণ ইশরাত কখনও খারাপ থাকত না।