শনিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সেই রাতের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে ওঠেন তারা

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
জুলাই ১, ২০১৭
news-image

ভয়াল সেই রাতের কথা আর মনে করতে চাই না। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি। শত চেষ্টা করছি ভোলার জন্য। কিন্তু পারছি না। সেই রাতের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি। মনে হয় আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। তাই এখন নতুন করে বাঁচতে চাই। নতুন করে স্বপ্ন দেখছি। কথাগুলো বলছিলেন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের কর্মী দ্বীন ইসলাম রাকিব। গতকাল গুলশানের হলি আর্টিজানের নতুন দোকানে স্মৃতি হাতড়ে রাকিব বলেন, সেই রাত ছিল আমার জীবনের একটি কালো রাত। সৃষ্টিকর্তা আর মা-বাবার দোয়ায় বেঁচে গেছি।

আমরা প্রায় ৬০ স্টাফ সেদিন কর্মরত ছিলাম। আমি কাজ করতাম কিচেনে। সেখানে আমি সহ মোট ১৩ জন ছিলাম। যখন গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই তখনই আমরা কিচেনের দরজা বন্ধ করে দেই। জঙ্গিরা এসে একবার দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলো। তারা হয়তো বুঝতে পারে আমরা স্টাফ। পরে আর আসেনি। রাকিব জানান, নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। সারা রাত পানি ছাড়া আর কিছু খাইনি। আমরা সবাই সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে ডেকে সময় পার করেছি। মনের ভেতর একটা আতঙ্ক বিরাজ করে। কখন কি হবে। আমাদের ওপর যদি আক্রমণ করে। যদি আমাদেরকে মেরে ফেলা হয়। তবে আমাদের কাছে মোবাইল থাকার কারণে বাড়িতে এবং আমাদের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। বাড়িতে মা এবং আমার ছোট বোনরা খুবই দুশ্চিন্তায় সময় কাটিয়েছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম ভয়ঙ্কর কিছু হতে যাচ্ছে।

রাত শেষে যখন সকাল হলো তখন আমাদের রেস্টুরেন্টের মালিক সাহাদাত মেহেদী আমাদেরকে মোবাইলে জানান ভয়ের কোনো কারণ নাই। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসেছেন। তারাই আমাদের উদ্ধার করবেন। সেনাবাহিনী যখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন আরো বেশি ভয় পাই। আমরা দরজার ভেতর থেকে বাঁচাও, বাঁচাও, বলতে থাকি। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদেরকে উদ্ধার করে। বাইরে বের হয়ে দেখি রক্তে লাল হয়ে আছে পুরো রেস্টুরেন্ট। এতো রক্ত দেখে আমার মাথা ঘুরছিল। সেই আতঙ্ক আজও মনে বিরাজ করছে। জানি না কতদিনে এই দৃশ্য ভুলতে পারবো।

 

পপিলসন চিরান (৩৫)। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার নগরসন্তোষ গ্রামের বাসিন্দা। পপিলসন গুলশানের হলি আর্টিজানের একসময়ের সার্ভিসম্যান। গত বছরের ১লা জুলাইয়ের সেই রাতে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সময় তিনিও সেখানে ছিলেন। তবে, ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। ভয়ঙ্কর সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মানবজমিনকে তিনি জানান, ওই দিন রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজানের নিচতলায় সার্ভিসম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ফ্লোরে তিনটি টেবিলের সিরিয়ালের একটির ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন পপিলসন। এ সময় হাসনাত করিম তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রবেশ করে একটি টেবিলে বসেন।

তিনটি সিরিয়ালের সব টেবিলই তখন পরিপূর্ণ। এর একটিতে ছিলেন বেশক’জন জাপানি নাগরিক। একটিতে ছিলেন ইতালির অন্তত ৮ জন নাগরিক। হাসনাত করিম খাবারের অর্ডার দেন। পাশে জাপানি নাগরিকদের অর্ডার আনতে যান পপিলসন। এ সময় একজন জাপানি তাকে জানান, পাশের দরজার বাইরে কেউ একজন দরজা খুলে দেয়ার ইশারা করছে। নিচতলার দরজা বাইরে থেকে খোলা যায় না। ভেতর থেকে খুলতে হয়।

পপিলসন বলেন, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন দরজা খুলে দেয়ার ইশারা করছে। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। তখনও বুঝতে পারিনি তারা ভয়ঙ্কর জঙ্গি। আমরা ভয় পেলাম। দরজা খোলার সাহস পেলাম না। ওরা তখন ওই দরজায় গুলিবর্ষণ করে। আমরা ভয়ে সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম। কেউ কেউ ফ্লোরে শুইয়ে পড়লো। তারা (জঙ্গি) তখন মূল দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সবার হাতেই অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এসেই তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে। আমি তখন ভেতরের একটি দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে নিচতলার বাথরুমে প্রবেশ করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার আগে বেকারির আরো অনেকেই বাথরুমে প্রবেশ করে এর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। পরে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে রেষ্টুরেন্টের কর্মীদের কিচেনে প্রবেশ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। একপর্যায়ে কিচেনের পাশে বেকারি রুমে যাই।

সেখানে মিকচার মেশিনের পাশে দেয়াল ঘেঁষে লুকিয়ে থাকি। তিনি বলেন, সেখান থেকেই নিচতলায় চিৎকার, গুলির আওয়াজ, ভাঙচুরের শব্দ, নারী ও শিশুদের কান্না শুনতে পাই। ১০/১৫ মিনিট পরে জঙ্গিদের একজন সেখানে আসে। প্রথমে চিনতে না পারলেও ঘটনার পর ছবি দেখে আন্দাজ করতে পারি সে ছিল জঙ্গি নিবরাস। তার হাতে রক্তমাখা লম্বা ছুরি। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। আমি ভয়ে আঁতকে উঠি। তবে, আমার সামনে দিয়ে ঘুরে গেলেও সম্ভবত আমাকে দেখতে পায়নি। সে তখন শেফ’র রুম ভাঙচুর করে। আর আমি একমনে প্রার্থনা করে যাচ্ছি। এই জায়গাটা নিরাপদ মনে না করে আবারো স্টাফ কিচেনের সামনে চলে যাই। সেখানে কিচেনের পাশেই সীমানা প্রাচীর। সীমানা প্রাচীরের পাশে রেস্তরাঁর কর্মীদের বিশ্রাম কক্ষ। সীমানা প্রাচীরের তারকাঁটা ধরে ওঠার চেষ্টা করি। কিন্তু লাভ হয়নি।

একপর্যায়ে কর্মীদের খাবার রুমের জানালায় ধাক্কা দিলে সেটি খুলে যায়। জানালা দিয়ে রেষ্টুরেন্টের ছাদে ওঠার চেষ্টা করি। তবে, আমার আগেই ছাদে রেস্টুরেন্টের কর্মীদের অনেকেই সেখানে ছিল। তারাই আমাকে ছাদে টেনে তুলে। ওদিকে নিচতলা ও দোতলায় জঙ্গিদের তাণ্ডব চলছেই। আমরা তখন ছাদে শুইয়ে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করি। বুঝতে পারছিলাম ভয়ঙ্কর কিছু হচ্ছে। চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ফোনে স্ত্রীকে বলি হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। সম্ভবত আমি বাঁচবো না। তবে, সৃষ্টিকর্তা আমার সহায় ছিল। একপর্যায়ে ছাদ থেকে যে যেভাবে পারি পাশের ফ্ল্যাটগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমিও ঝাঁপ দিয়ে উত্তর পাশের একটি ফ্ল্যাটের নিচে নেমে সাহায্য চাই।

ওদের সাহায্যে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ঝিলপাড় হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের পেছন দিক দিয়ে নর্দ্দা হয়ে শাহজাদপুরে আমার বাসায় চলে যাই। পপিলসন বলেন, এমন ভয়ঙ্কর রাতের কথা আমি ভুলে যেতে চাই। ওই রাতে আমি বেঁচে গেলেও আমাদের অন্য কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর উন্মত্ততার বিষয়টি জানতে পারি।
হলি আর্টিজানে সেই রাতে কফিশপের দায়িত্বে ছিলেন শাহরিয়ার আহমেদ (৩০)। ঘটনার ভয়াবহতা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। শাহরিয়ার বলেন, আমিসহ আরো কয়েকজন প্রায় সারারাত রেষ্টুরেন্টের নিচতলার বাথরুমে জিম্মি অবস্থায় ছিলাম। তবে, এরমধ্যেই জঙ্গিদের আক্রমণ তাদের বীভৎসতা টের পাই। নারী, পুরুষ ও শিশুদের চিৎকার শুনতে পাই। বীভৎস হত্যাকাণ্ড হচ্ছে সেটিও বুঝতে পারি।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এত হত্যা ও রক্ত দেখার পরও তারা ছিল প্রায় স্বাভাবিক। কোনোরকম অস্থিরতা তাদের মধ্যে দেখিনি। এতকিছুর পরও তারা রান্না করা খাবার খেয়েছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। শাহরিয়ার বলেন, প্রায় ১১ ঘণ্টা জিম্মি অবস্থা থেকে সকালে আমাদের উদ্ধার করা হলো। হলি আর্টিজানের নিচতলায় তখন লাশ আর লাশ। রক্তে ভেসে গেছে পুরোটা ফ্লোর। তিনি বলেন, সেই রাতের স্মৃতি ভুলে যেতে চাই। এটি খুব কষ্টকর অভিজ্ঞতা। বলে বোঝানো যাবে না। এখনো দুঃস্বপ্ন দেখি। চোখের সামনেই দেখতে পাই সেই রাতের ভয়াবহতা। সাংবাদিকসহ অনেকেই ওই রাতের স্মৃতি আমার কাছে জানতে চান। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে না। এ ধরনের ভয়ঙ্কর কষ্টের স্মৃতি কাউকে বলা যায় না। এত খারাপ অভিজ্ঞতা খুব কম মানুষেরই হয়েছে।

 

এদিকে পুরাতন হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের আশেপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এখনো তাদের ভেতর সেই ভয়াল রাতের আতঙ্ক বিরাজ করছে। নীরব নিস্তব্ধ এই রোডে মানুষের আনাগোনা এখন অনেকটা কমে গেছে। রেস্টুরেন্টের পাশেই ১৫ নম্বর বাসা (মেনর মেরডিয়ানা ভবনের) নিরাপত্তা কর্মী বকুল হোসেন বলেন, সেই রাতের কথা কোনোদিন ভোলা যাবে না। নিজ কানে কখনো এতো গোলাগুলির শব্দ আর কখনো শুনি নাই। পুলিশ, র‌্যাব, বিডিআর, সেনাবাহিনীর সদস্যরা দলবেঁধে ঘোরাঘুরি করছিলো। একটার পর একটা অ্যাম্বুলেন্স আসা-যাওয়া করে। তখন ভেবেছিলাম হয়তো শত শত মানুষ মারা গেছে। আমরা গেইটের ভেতর থেকে বের হতে পারছিলাম না। ঘটনা শুরু হওয়ার পর পরই পুলিশ বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়। ভেতরে আমরা সহকর্মীরা ভয়ে ইতস্তত হয়ে পড়ি।

 

যখন শুনলাম সন্ত্রাসীরা পুলিশকে গুলি করে মেরেছে। তখন নিজের আশা ছেড়ে দেই। যেখানে পুলিশ মারতে পারছে আমরা তো সাধারণ মানুষ। বাড়িতে মোবাইল করে সবার কাছ থেকে দোয়া চেয়ে নেই। আর সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকি। ভয়ে পালানোরও কোনো সুযোগ ছিল না। ঘটনার দুইদিন পরও আমাদেরকে বাসা থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। একই বাসার লিফটম্যান মো. হাসান জানান, ভাবিনি বেঁচে যাবো। সৃষ্টিকর্তার কারণে হয়তো বেঁচে গেছি। কিন্তু সেই আতঙ্ক এখনো কাটেনি। থমথমে সেই রাত। কি হবে। কি হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের আর গোলাগুলির শব্দ। সব মিলিয়ে অন্য রকম একটা রাত কাটিয়েছি। ৭৯ নম্বর সড়কের পাশেই তার বাসা। সেদিন রাতে তিনি বাসায় ছিলেন। আরব আলী বলেন, সন্ধ্যার পরপরই গোলাগুলির শব্দ শুনি। তারপর আর আমরা বাইরে বের হইনি। জানালা দিয়ে দেখছিলাম একের পর এক পুলিশের গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স যাওয়া-আসা করছিলো। আমরা আশেপাশে যারা ছিলাম সবার মাঝেই একটা আতঙ্ক বিরাজ করে। মানব জমিন