রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে
রাজধানী অপরিচ্ছন্ন ও দূষিত হওয়ার যত ধরনের কর্মকান্ড রয়েছে, তার সবই নির্বিঘে চলছে। রাজধানীর এই পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই, এর কোনো কর্তৃপক্ষ রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডের দীর্ঘসূত্রতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বছরের পর বছর ধরে বর্ষায় রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত ও পানিতে যেমন তলিয়ে যায়, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে তা ধুলো ধূসরিত হয়ে পড়ে। রাস্তা দিয়ে স্বাভাবিক ও স্বস্তিকরভাবে চলাচলের কোনো উপায় থাকে না। রাজধানীর বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এতটাই সীমাছাড়া হয়েছে যে, মানুষ নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক নানা সমস্যা সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের মানসিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, অ্যাজমা, অ্যালার্জিসহ নানা ধরনের জটিল রোগ নগরবাসীর শরীরে বাসা বাঁধছে। গত সপ্তাহে ভারতের রাজধানী দিল্লী বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় সেখানের স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দূষিত ও ঘোলাটে ধোঁয়া শহরটিকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, সূর্য পর্যন্ত দেখা যায়নি। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় যেভাবে দূষণ কর্মকান্ড চলছে, তাতে দিল্লীর মতো হতে খুব বেশি দেরি হবে না। রাজধানীর দূষিত পরিবেশের পাশাপাশি এর সৌন্দর্য বিনষ্টের আরেকটি উৎপাত হচ্ছে, যত্রতত্র বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা। ভিআইপি সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে সৌন্দর্য বিনষ্টকারি এসব উপকরণ চোখে পড়ে না। রাজধানীতে এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও কর্মকান্ড আর কোনো দেশে ঘটে কিনা, জানা নাই।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী হিসেবে ঢাকা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম বা তৃতীয়। দূষণের বাইরে বসবাস অযোগ্য নগরী হিসেবে ঢাকা বেশ কয়েকবার এক নম্বরে ছিল। এতে অবশ্য ঢাকার পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের কিছু যায় আসেনি। যেমন চলছে, তেমন চলবে-এমন একরোখা মনোভাবই প্রদর্শিত হচ্ছে। দিন দিন আরও খারাপের দিকে গেলেও তাতে কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই। রাস্তার খোঁড়াখুড়ির কথা যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে, এর কোনো সময়কাল নেই। শীত-বর্ষা থেকে শুরু করে সারাবছরই অবিরাম খোঁড়াখুড়ি চলছে। রাজধানীর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব খোঁড়াখুড়িকে উন্নয়ন কর্মকান্ড বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। উন্নয়ন চাইলে ভোগান্তি সইতে হবে, এ বার্তাই যেন নগরবাসীকে তারা সবসময় দিয়ে আসছে। উন্নয়ন নিয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়, তবে সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতো, তবে ভোগান্তি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। একটি রাস্তা একবার খোঁড়া হলে তা কবে ঠিক হবে, তার কোনো সময়সীমা থাকে না। এক প্রতিষ্ঠান খুঁড়ে কোনো রকমে মাটিচাপা দিয়ে গেলে আরেক প্রতিষ্ঠান খুঁড়তে শুরু করে। খোঁড়াখুড়িও শুরু হয় বর্ষাকালে। ফলে বৃষ্টি হলে খুঁড়িত স্থানগুলো যেমন তলিয়ে বিপজ্জনক ফাঁদে পরিণত হয়, তেমনি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখন অবশ্য খোঁড়াখুড়ি সারাবছরই চলে। এই উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি কবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। যেহেতু এর শেষ নেই, তাই এ কর্মকান্ডকে অন্তত একটি পরিকল্পনার আওতায় আনা অসম্ভব কিছু নয়। এজন্য প্রয়োজন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং সদিচ্ছা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে এর লেশমাত্র নেই, তা তাদের কর্মকান্ড থেকেই বোঝা যায়। পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে যদি দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা হয়, তবে নগরীকে যে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করা যায়, তা ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের নেয়া কিছু উদ্যোগ থেকে প্রমাণিত হয়েছে। তার আওতাধীন এলাকায় তিনি দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে পরিবেশ, সড়ক ও ফুটপাতের যে উন্নয়ন করেছেন, তার সুফল কিছুটা হলেও ঐ এলাকার মানুষ পাচ্ছে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এমন মনোভাব পোষণ করতো, তবে রাজধানীকে বাসযোগ্য করে তোলা অনেকটাই সহজ হয়ে যেত। পরিবেশ দূষণ হ্রাস থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট চলাচল উপযোগী হতো। রাজধানীর সৌন্দর্য ও পরিবেশ দূষণের আরেকটি বড় উপদ্রব হচ্ছে যত্রতত্র ডিজিটাল ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ঝুলিয়ে রাখা। এগুলোর কারণে নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্টের পাশাপাশি দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। এসব কাজে ক্ষমতাসীন দল এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যে এগিয়ে, তা রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়। মাসের পর মাস এসব ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলে আছে। সরানোর নামগন্ধ নেই। আবার ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা রাজপথ দখল করেই তোরণ নির্মাণ করে রেখেছে। এতে যে যানজট সৃষ্টি ও সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে, তার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ক্ষমতার অপব্যবহার কতভাবে হতে পারে, তা এসব কর্মকান্ড দেখলেই বোঝা যায়।
রাজধানীকে অবাসযোগ্য ও অপরিচ্ছন্ন রেখে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আশা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। একটি মধ্যম আয়ের দেশের রাজধানী কেমন হয়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। পানিবদ্ধতা, যানজট, পরিবেশ দূষণের তীব্রতা বজায় রেখে যদি মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণা করা হয়, তবে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করতে রাজধানীকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা ছাড়া বিকল্প নেই। অসময়ে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি, পানিবদ্ধতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ধুলিদূষণ বন্ধ এবং যত্রতত্র ব্যানার-ফেস্টুন টানানোর মতো অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগরীর গতিশীল ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন চলছে, তেমন চলবে-এ ধরনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সমন্বয়ের মাধ্যমে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। নগরীকে সভ্য ও বাসযোগ্য করে তুলতে নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।