বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সচেতনতাই হলো যক্ষ্মা প্রতিরোধের একমাত্র উপায়

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
এপ্রিল ২, ২০২০
news-image

গত বছর মিসেস সালেহা চৌধুরীর গলার কাছে একটি ফোড়ার মতো হয়। শুরুতে বিষয়টিকে তেমন
একটা আমলে না নিলেও পরে এতে ব্যথা শুরু হলে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানতে পারেন যে তার গলায় যক্ষ্মা হয়েছে। তিনি শুরুতেই ভেবেছিলেন এটি ব্রণের মতোই হয়তো সাধারণ কোনো ফোঁড়া যেটা দুই একটা ওষুধেই সেরে যাবে। কিন্তু গলার এই ফোঁড়ার কারণে যে যক্ষ্মা হতে পারে তিনি ভাবতেও পারেননি। পরে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে নয় মাসের ঔষধ খেয়ে পুরোপুরি সুস্থ আছেন। মিসেস সালেহা চৌধুরী তার আশেপাশের মানুষকে সচেতন করেছেন যে যক্ষ্মা কেবল ফুসফুসের রোগ নয়। সুদীর্ঘকাল ধরে যক্ষ্মা বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান সংক্রামক রোগের স্থান দখল করে রেখেছে।

এ রোগে বিশ্বে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে দারিদ্র এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। যক্ষ্মা রোগের ক্ষতিকর দিক বিশেষ করে স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি
সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হয়ে থাকে। ১৮৮২ সালের এ দিনে ড. রর্বাট কোচ যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার, রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের পথ উন্মোচন করেন। তাকে স্মরণ করেই এই দিনটিতে যক্ষ্মা দিবস পালিত হয়ে থাকে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য “It’s Time”।

একটা সময় বলা হতো ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’ তবে এখন ধারণাটি অনেক বদলেছে।
এরপরও যক্ষ্মা হচ্ছে। কারণ টিবি বা যক্ষ্মা একটি মারাত্মক সংক্রামক ছোঁযাচে রোগ। যা প্রধানত
ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। যক্ষ্মা বলতে সাধারণভাবে আমরা ফুসফুসের যক্ষ্মাকেই বুঝি। এই রোগ
Mycobacterium tuberculosis (MTB) এর মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে মানব
শরীরে ছাড়ায়। তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে যক্ষ্মা হতে পারে। যেমন- লসিকাগন্থি,
হাড় ও গিট, অন্ত্র, হৃদপিণ্ডের আবরণ ও মস্তিষ্কের আবরণ, লিভারে এমনকি পাকস্থলিতেও হতে
পারে।

বিশ্বে টিবি সংক্রমণে মানুষের মৃত্যুর হার দ্বিতীয় স্থানে। যক্ষ্মা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত রোগ। এর মধ্যে যক্ষ্মা রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে ২২টি দেশ। যক্ষ্মা এমন একটি রোগ যেটা হাঁচি, কাশি ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি পরিবারে অনেক লোক একসঙ্গে বসবাস করে। একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যান্য লোকও আক্রান্ত হতে পারে, আর সেই জন্যই প্রতি বছর যক্ষ্মা বা টিবির নতুন নতুন রোগী তৈরি হচ্ছে।

সাধারণভাবে বলা যায় যক্ষ্মা বা টিবি রোগের প্রধান লক্ষণগুলো হলো- সাধারণত তিন
সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি ও জ্বর; কাশির সঙ্গে কফ এবং রক্ত আসা; বুকব্যাথা অথবা শ্বাস
নেয়ার সময় অথবা কাশির সময় ব্যথা হওয়া; ওজন কমে যাওয়া; শারীরিক দুর্বলতা ক্ষুধামান্দা বা
খাদ্যে অরুচি, অবসাদ অনুভব করা ইত্যাদি। শরীরের যে অংশে যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হবে সেই
অংশটি ফুলে উঠবে। যেমন- গলার গ্রান্ড আক্রান্ত হলে গলা ফুলবে, মেরুদণ্ড আক্রান্ত হলে পুরো
মেরুদণ্ড ফুলে উঠবে। ফোলা অংশটি খুব শক্ত বা একদম পানি পানি হবে না, সেমি সলিড হবে। ফোলার
আকার বেশি হলে ব্যথাও হতে পারে। লিভারে যক্ষ্মা হলে পেটে পানি চলে আসে। তাই পেট ও অস্বাভাবিক ফুলে যায়। মাস্তিষ্কে সংক্রমিত হলে সেখানেও পানির মাত্রা বেড়ে যায়।

এছাড়াও চামড়ায় বা অন্য যেখানেই হোক না কেন সেই অংশটা ফুলে ওঠে। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ জন্মগতভাবেই যক্ষ্মা রোগের জীবাণু বহন করে থাকে। তবে শরীরে জীবাণু থাকা মানেই এই নয় যে ব্যক্তি রোগে আক্রান্ত। তবে জীবাণুর ধারক নিজে আক্রান্ত না হলেও তার মাধ্যমে অন্যের শরীরে যক্ষ্মা ছড়াতে পারে। আর সেটা যেকোনো অঙ্গেই হতে পারে।

আর এই জীবাণু থেকে তাদেরই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে যাদের রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা দুর্বল। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী এবং এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের এই জীবাণুতে
সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। দেখা গেছে, আফ্রিকা বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকা,
আফগানিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর আমেরিকা, পাকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশের
মানুষের যক্ষা হওয়ার প্রকোপ বেশি।
সাধারণত যক্ষ্মা বা টিবি দুই ধরনের হয়ে থাকে, ফুসফুসে যক্ষ্মা ও ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা।
এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ হলো ফুসফুসের যক্ষ্মা আর ১৫ শতাংশ অন্যান্য যক্ষ্মা। সাধারণত ১৫ থেকে
৪০ বয়সের লোকেরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের দশটি মৃত্যুজনিত কারণের মধ্যে
যক্ষ্মা অন্যতম। আর বিশ্বের এক চতুর্থাংশ মানুষের দেহে এই রোগ সুপ্ত অবস্থায় আছে, যা
সাধারণত সংক্রমণ ঘটায় না, তবে এদের মধ্যে পাঁচ থেকে পনেরো ভাগ মানুষের জীবনে যক্ষ্মার
সংক্রমণ হতে পারে।

তবে এই রোগ নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব। যক্ষা রোগীর প্লেট, গ্লাস,
বিছানা আলাদা করে দেওয়ার দরকার নেই। কারণ বাতাসের মাধ্যমে যক্ষা রোগের জীবানু ছাড়ায়। এ
রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, তাই যার এ রোগ রয়েছে তাকে কিছু বিষয়ে
সর্তক হতে হবে। হাঁচি বা কাশির সময় মুখে রুমাল দেওয়া, হাত দিয়ে মুখ ঢাকা অথবা এক দিকে সরে
কাশি দিতে হবে। যেখানে সেখানে কফ বা থুতু ফেলা যাবে না। আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের কাছাকাছি গিয়ে
কথা বললে এ রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। রোগীর কফ বা থুতু নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলে তা মাটিতে পুঁতে
ফেলতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে যক্ষার জীবাণু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা দুর্বল হলে যক্ষার জীবাণু ফুসফুসে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং তা
রোগ প্রতিরোধী কোষগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে। বছরের পর বছর ধরে যক্ষার জীবাণু শরীরে থাকলে
পরবর্তীতে এটি সক্রিয় যক্ষায় রোগ নিতে পারে। সাধারণত বয়স, ঔষধ সেবন, অপুষ্টি, কেমোথেরাপী,
মদপান ইত্যাদির জন্য রোগ প্রতিরোধ কমে গেলে সক্রিয় যক্ষা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
যক্ষা শনাক্ত হওয়ার পর নিয়ম মেনে পূর্ণাঙ্গ ডোজ ঔষুধ সেবন করতে হয় যক্ষা রোগীকে।
কিন্তু কিছুদিন ঔষুধ সেবনের পর কিছুটা ভালো মনে হলেই ঔষধ বন্ধ করে দেন রোগীরা। অনেক রোগী
পূর্ণাঙ্গ ডোজ আর শেষ করেন না। এতে করে ঐ রোগীর নরমাল যক্ষা থেকে ঔষুধ প্রতিরোধী যক্ষার
আক্রান্তের আশঙ্কা দেখা দেয়। অর্থাৎ আগের নরমাল ঔষধগুলো ঐ রোগীর শরীরে আর কাজ
করেনা । যার কারণে আরো দামি ঔষুধের পাশাপাশি উচ্চ দামের ইনজেকশন দিতে হয় ডিআর যক্ষা
রোগীকে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার যক্ষা রোগী মারা যাচ্ছে।
ডব্লিউএইচও’র সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবালটি উবায়কিজ লাসিস রির্পোট ২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যক্ষা রোগীর সংখ্যা ৩লাখ ৫৭ হাজার । সে হিসেবে প্রতি লাখে ২২১জন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। গত বছর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৪৭ হাজারের । এর মধ্যে ১৯০ জনই ছিলেন এইডসে আক্রান্ত । এ ছাড়া ঔষুধ প্রতিরোধী যক্ষায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৯০০।

তবে যক্ষা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এগিয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে বলা হয় যক্ষা চিকিৎসার আওতায় বাড়ানোর ক্ষেত্রে আগের তুলনায় এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে দেশে যক্ষা চিকিৎসার আওতাভুক্ত রোগীর হার ছিল ৭৫ শতাংশ । ২০২২ সাল নাগাদ এটিকে ৯০শতাংশে উর্ত্তীণ করার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া দেশে ৯৪শতাংশ ক্ষেত্রেই যক্ষার চিকিৎসার সাফল্য মিলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের সকল- উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল বক্ষব্যাধি ক্লিনিক
হাসপাতাল, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এনজিও ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহ বিনামূল্যে
কফ পরীক্ষা, রোগ নির্ণয়সহ যক্ষার চিকিৎসা করা হয় ও ঔষধ দেওয়া হয়। যক্ষা হলে ত্বকের
পরীক্ষা, রক্তের পরীক্ষা, কফ পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে পরীক্ষা অথবা সিটি স্ক্যান এবং কালাচার
টেস্টও করানো হয়ে থাকে।
যক্ষা নিরাময়ে নিয়মিত ওষুধ সেবনের পাশাপাশি রোগীর খাদ্যাভ্যাসের দিকটিও খুব
গুরুত্বপূর্ণ। যক্ষারোগীর খাদ্য তালিকায় অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট
থাকতে হবে। কোনোভাবেই লো-কার্ব ডায়েট দেওয়া ঠিক হবে না। প্রধান খাবার হতে পারে লাল চালের
ভাত, রুটি, খিচুড়ি, হালুয়া প্রভুতি। এছাড়াও আমিষ বা প্রোটি, ভিটামিন, মিনারেলস আয়রন ও জিংক
সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
সরকার প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে বদ্ধ পরিকর। স্বাস্থ্য খাতে সমতা
আনতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। সরকার বিনামূল্যে যক্ষা রোগীদের ওষুধ দিচ্ছেন। এ ছাড়াও
মারণব্যাধি যক্ষা নির্ণয়ে নামনো হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সংযোজিত ভ্রাম্যমান গাড়ি।
সরকার বাংলাদেশে ওষুধ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সর্বোপরি একটা কথা বলা যায় অতীতে মানুষের যক্ষা ধরা পড়লে হতাশ হয়ে জীবন যাপন
করতে হতো। কারণ তখন যক্ষার কোনো ঔষধ ছিলনা। ফলে মানুষ খুবই ভয় পেত। আজ আর সেই দিন
নেই। যক্ষার ওষুধ নিয়মিত সেবন করলে এবং সঠিক নিয়মে খাদ্যবিধি মেনে চললে যক্ষা সম্পূর্ণরূপে
নির্মূল করা সম্ভব।

ডা. সাঈদ আনোয়ার

এ জাতীয় আরও খবর