বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

তারুণ্যের আদর্শ

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
আগস্ট ৬, ২০১৭
news-image

শেখ কামাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪৯ সালের ৫ই আগস্ট, গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর হাত ধরে তাঁর সম-সাময়িক লক্ষ-কোটি তরুণ দেখেছিল এক আলোর সন্ধান। তাঁর হাত ধরে ঐ সময়ের তরুণরা চলতে শুরু করেছিল আলোর পথে। অনেক বড় পরিবারের ছেলে হওয়া স্বত্বেও তিনি ছিলেন নিরহংকারী। খুব সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। তাঁর বাবা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তিনি ছিলেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, বাংলাদেশের জাতির পিতার সন্তান। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধুর এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে তিনিও নিহত হন।

জাতির পিতার সন্তান হওয়া স্বত্বেও পরিবারের অন্য সদস্যরা ছিলেন সাধারণ মানুষের মতো। তাদের জীবন ধারণও ছিল খুব সহজ সরলতার মধ্যে। পারিবারিক বন্ধন ছিল অটুট, বন্ধুবৎসল। লেখাপড়ায় শেখ কামাল ছিলেন খুবই মেধাবী। ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ-বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি সমাজ বিজ্ঞানে এমএ শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

একটি সংস্কৃতি-মনা পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। বাঙ্গালির পরিচয় যে সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে নয় তা শেখ কামালের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। মঞ্চ নাটক করতেন। সেই সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভালো সংগঠক ছিলেন। বন্ধুদের মধ্যে যারা শিল্পী ছিলেন তাদের নিয়ে “স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী” নামে একটি সংগঠনও তৈরি করেছিলেন। ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। ভাল অভিনেতা হিসেবে তাঁর সুনামও ছিল। মোট কথা পুরা-দমে একজন সংস্কৃতি-মনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেখ কামাল।

শুধু কি তাই? শেখ কামাল একজন ভালো ক্রীড়া সংগঠকও ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই তাঁর খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। আজকের বিখ্যাত ক্রীড়া ক্লাব “আবাহনী ক্রীড়া চক্র”-এর তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। দক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে এই ক্লাবের জন্যে তিনি ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড় সৃষ্টি, বাছাই এবং তাদের অনুশীলনের জন্য তিনি নিজেই সব দেখভাল করতেন। সবচেয়ে মজার বিশয় এই যে তিনি একজন দক্ষ সমাজ, সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন এবং জীবনের চলার পথে যার হাত ধরে জীবনটা শুরু করতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ তাঁর সহধর্মীনি ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ “সুলতানা খুকু”/ ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামাল ও সুলতানা খুকু বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

শেখ কামাল দেশ মাতৃকার প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ছিলেন দেশ প্রেমিক বাবার দেশপ্রেমিক সন্তান। তাই তো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ীতে বসে থাকেননি। ১৯৭১ সালের ১৫ শে মার্চ রাতেই বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন সংগ্রামী আদর্শবাদী কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ৬৬ এর স্বাধিকার আন্দোলন ৬৯ এর গন আন্দোলন ও ৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং সেনা প্রধান এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ কামাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই তরুণ মানুষটি থেমে থাকেননি। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে পড়াশোনার দিকে আবার ঝুঁকে পড়েন এবং সেই সাথে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন শেখ কামাল।

২৬ বছরের এক টগবগে তরুণ ছিলেন শেখ কামাল। তাঁর এই ছোট জীবন পরিধিতে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল উদীয়মান জ্বলজ্বলে তারা। তারুণ্যের প্রতীক। এই ২৬ বছরের জীবনে অনেক কিছু করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে হায়েনাদের চক্রান্ত থেমে থাকেনি। তাঁর নামে ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ এনে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে যা পরবর্তীতে টিকে থাকতে পারেনি। কারণ, ইতিহাস কখনও মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বিখ্যাত অভিনেত্রী “ডলি জহুর” বলেছিলেন, আমি খুব কষ্ট পাই, অভিশাপ দেই, যখন দেখি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে চিরকাল মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত, কাল্পনিক অভিযোগের কথা শুনি। অনেকে জানেন যে, এসব মিথ্যা ও বানোয়াট। পাছে আওয়ামীলীগ সিল লেগে যায় এই জন্যে তারা এসব সত্যের বিষয়ে মুখ খোলেননি। আর এইসব ঘটনা বের করে আনার জন্যে মিডিয়ার ভূমিকাও দরকার। কারণ, এই মিথ্যাচারের মাধ্যম ও বাহন ছিল গণমাধ্যম ও তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ছোট বোনের বান্ধবীকে নিজের বোনের মতো করে গাইড করা, অনেক রাতে নাটকের রিহার্সাল শেষ হলে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার মত দায়িত্ববোধ যে তরুণের আছে, তার সম্পর্কে ধারনা লাভ করে কঠিন কিছু না। প্রেসিডেন্টের ছেলে হয়ে যার মধ্যে ছিল না অহংকার। পকেটে টাকা না থাকলে যিনি হেটে বাড়ি ফিরতেন। তরুণ বয়সে একজন ছেলের একটি মেয়েকে ভাল লাগতেই পারে। তাইতো ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন তার মতো একজন ক্রীড়াবিদকে। ঘাতকের আঘাতে তার প্রিয় সহধর্মীনির মৃত্যু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর লাশ মানুষকে দেখতে না দেওয়া, বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ঘৃণা করতে শেখানোর যে অপচেষ্টা, শেখ কামালও অপচেষ্টার শিকার। যে লোক পয়সার অভাবে হেঁটে বাসায় ফিরত, সে লোক করবে ব্যাংক ডাকাতি? ইতিহাসকে কখনো চেপে রাখা যায় না। খুনিরা প্রথমে খুন করে, তারপর সেই খুনকে জায়েজ করার জন্যে খুন হওয়া ব্যক্তির নামে অপপ্রচার চালায়। শেখ কামালের ব্যাপারেও সেটি ঘটেছে।

শেখ কামাল একজন দক্ষ, বিচক্ষণ সংগঠক ছিলেন তাইতো যুদ্ধের ময়দানে স্বাধীন বাংলার ফুটবল ম্যানেজার তানভীর মাঝার তান্নার সাথে যুদ্ধে প্রায় আলাপ হলেই উনি বলতেন, “তান্না, আমরা কি ফিরে যেতে পারব না? দেখে নিস, স্বাধীন হলে খেলার ছবিটাই বদলে দিব আমি”। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। ১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী আই এফ এ শীল্ড ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে যায় তখন আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও তার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে।

ভাইবোনদের সাথে সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গমাতা বেগম মুজিব শেখ কামালকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে জেলে দেখা করতে গিয়েছিলেন। এমনিতেই রাজনৈতিক কারণে পিতার সাথে তার দেখা তেমন হতো না। তাইতো জেল গেটে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বুবু তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা ডাকি?” এমন একজন মানুষকে নিয়ে আমরা কত প্রোপাগান্ডাই না করেছি!

শেখ কামালের মিথ্যাচার নিয়ে যখন অনেকেই না জেনে কথা বলে, তখনই হাসি পায়। যে ব্যাংক ডাকাতির কথা বলা হয়, সেইখানে দুষ্কৃতিকারীদের ধরতে পুলিশের সাথে শেখ কামালের বন্ধু ও সিনিয়ররাও যোগ দেন। তার সাথে ছিলেন বি.এন.পির ইকবাল হাসান টুকু। তার ড্রাইভার ছিলেন সেই টুকু। জাপার কাজী ফিরোজ রশিদ ছিলেন তার সিনিয়র, তিনিও ছিলেন সেই জীপে। ঐ সময়ের “দৈনিক মর্নিং নিউজ” এর সাংবাদিক প্রয়াত এবি এম মুসা পরদিন প্রত্রিকায় এর সত্যতা প্রকাশ করেন।

পৃথিবীতে ভাল মানুষকে ভালো কাজের জন্যে জীবন দিতে হয়। অনেক ধৈর্য ত্যাগ-তিতিক্ষা কষ্ট সহ্য করতে। বঙ্গবন্ধু পরিবার তার মধ্যে অন্যতম। এদেশীয় দালাল এবং বিদেশী শক্তি এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তে ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নিহত হন। আজ যদি শেখ কামাল বেঁচে থাকতেন কেমন হতেন তিনি? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে খুব জাগে। ২০১৬ সালের এ আধুনিক যুগে তিনি হতেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই তরুণ-সমাজকে আরও মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করতে কাজ করতেন। যে তরুণ তাঁর জীবনের ২৬ বছরে এত কর্ম-দীপ্ত ছিলেন, বেঁচে থাকলে হয়ত আরও কিছু করে যেতে পারতেন দেশের জন্যে। দেশের তরুণদের জন্যে। শেখ কামাল একজন ইয়ুথ আইকন। আজও, এখনও… । খুনিরা হয়তো তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তাঁর অবদানকে মুছে দিতে পারেনি। কারণ, হিরো’জ নেভার ডাই…।

শুভ জন্মদিন শেখ কামাল।

লেখক : ডাইরেক্টর, রেডিও ঢোল, এফএম ৯৪.০, ফাউন্ডার, দ্যা লাভলি ফাউন্ডেশন।