শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংগ্রহের পর শাক-সবজি সংরক্ষণে করণীয় : ড. মো: বাশারত আলী সরকার

সেরাকণ্ঠ ডট কম :
জুলাই ২, ২০১৭
news-image

সুস্বাদু খাবার পছন্দ করে না এমন মানুষ খু্ঁজে পাওয়া ভার। স্বাদে গন্ধে পুষ্টিতে দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় যদি হয় সে খাদ্য সম্ভার। সামর্থ অনুযায়ী ভোজন বিলাসী সব মানুষই। নির্ভেজাল পুষ্টিকর পরিমিত খাদ্য খেয়ে সুস্থ থাকতে চাই সবাই। তবে, পুষ্টি সমৃদ্ধ সতেজ নির্ভেজাল শাক-সবজি, ফলমূল বাজারে মেলেই না আজকাল। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে সে সব দিনকাল যখন, সতেজ পুষ্টিকর শাক-সবজি ফলমূল সবই ছিল একদম নির্ভেজাল।

আজকাল এসব কাঁচা দ্রব্যাদির জন্য অধিকাংশ মানুষকেই হতে হচ্ছে বাজারের উপর নির্ভরশীল। কোথায় পাবো আগের মতো জমি থেকে সদ্য উঠানো সবজি-ফলমূল? ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে সংরক্ষণ করার কারণে পুষ্টিমান ও গুণাগুণ হারিয়ে এসব মূল্যবান শাক-সবজি ও ফল, খাদ্য হিসেবে হয়ে যেতে পারে পুরোটাই বিফল।

আমাদের জনসংখ্যা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ কয়েক গুণ। চাষের জমি কমেছে। খাদ্য চাহিদা বেড়েছে। তারপরও আল্লাহর রহমতে উন্নত কৃষি বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগে অল্প জমিতেই ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তবে সব ফসলের ফলন আমরা সমানভানে বাড়াতে পারিনি। বিশেষ করে ফলমূল শাক-সবজির উৎপাদন আমাদের চাহিদা-ঘোড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পায়নি। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অপরদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, কারখানা ইত্যাদি তৈরির ফলে চাষাবাদের জমি কমে যাচ্ছে। অবস্থার প্রেক্ষিতেই মানুষের পেশাও পরিবর্তিত হচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে অনেক মানুষ শহরের পানে ছুটছে। শহরে বসবাসকারী এবং ভূমিহীন গ্রামবাসী তাদের শাক-সবজি, ফলমূলের জন্য কাঁচা বাজারের উপর নির্ভরশীল। পচনশীল এসব খাদ্যদ্রব্য গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছতে নানান ধকল সামলাতে হয়। ইদানিং যে বিষয়টি স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো শাক-সবজি ফলমূল, রোগ পোকা মাকড় মূক্ত রাখার জন্য কোন কোন চাষী বা ব্যবসায়ী নির্বিচারে বিষাক্ত কীটনাশক বা রোগনাশকের ব্যবহার এবং পচনশীল শাক-সবজি, ফলমূল দীর্ঘদিন গ্রাহকের দৃষ্টিতে সতেজ দেখানোর প্রয়াসে নানান ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার। আমাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

জমি থেকে তথা গাছ থেকে শাক-সবজি, ফলমূল সংগ্রহ করার পর এসব পচনশীল খাদ্য দ্রব্যের পুষ্টিমান ও গুণাগুণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। সদ্য সংগৃহীত এসব পচনশীল দ্রব্যের গুনাগুণের ক্রম অবনতি রোধ কল্পে আমাদের করণীয় কি সে বিষয়ে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

সতেজ শাক-সবজি, ফলমূল সংগ্রহের পর তার অভ্যন্তরে কি ঘটে?
আমরা জানি শাক-সবজি ফলমূল ইত্যাদি সংগ্রহের পর পরই গাছ থেকে এদের খাদ্য বা পুষ্টি উপাদান গ্রহণ বন্ধ হয়ে য়ায়। অর্থাৎ সংগ্রহের সময় ফলমূল শাক-সবজিতে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান থাকে সেটিই সর্বোচ্চ। ফসল সংগ্রহের পর এ পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ আর বৃদ্ধি পায় না। উপরন্তু ক্রমেই তা কমতে থাকে। কি হারে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ও খাদ্যোপযোগী গুণাগুণ কমবে তা বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের মনে রাখতে হবে, গাছ থেকে ফলমূল শাক-সবজি সংগ্রহের পরও ওদের কোষগুলো জীবন্ত থাকে। অর্থাৎ এসব সতেজ দ্রব্যের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ তখনও চলতে থাকে। আমরা জানি শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবকোষ তার খাদ্য উপাদান তথা কার্বোহাইড্রেড ভেঙে কার্বোনডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প তৈরি করে এবং এনার্জি পেয়ে থাকে। এই এনার্জি কাজে লাগিয়ে জীবকোষগুলো বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। লক্ষণীয় যে, শ্বাস- প্রশ্বাসের ফলে আমাদের সতেজ খাদ্য দ্রব্যগুলো তার অভ্যন্তরীণ উপাদান হারিয়ে ফেলে, ফলে ওজন ও গুণাগুণ হ্রাস পায়।

মাঠ থেকে তথা গাছ থেকে সংগ্রহের পর পচনশীল এসব সামগ্রী নানান ভাবে গুণাগুণ হারাতে থাকে। যেমন: কার্বোন ডাই- অক্সাইড সৃষ্টির ফলে কার্বোহাইড্রেড হ্রাস পাওয়া, জলীয় পদার্থের হ্রাস, তাপের কারণে ক্ষত হওয়া, ফসল সংগ্রহ ও স্থানান্তরের সময় আঘাৎজনিত ক্ষত হওয়া, দাগ পড়া, পোকায় খাওয়া, রোগ-জীবাণুর আক্রমণের ফলে পঁচে যাওয়া ইত্যাদি। বাতাসের আর্দ্রতা, গ্যাসীয় উপাদান, তাপমাত্রা ইত্যাদি এসব ক্ষয় ক্ষতির প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
উপযুক্ত পরিপক্ক অবস্থায় অনুকূল পরিবেশে ফসল সংগ্রহ করলে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময় সে ফসল ঘরে সংরক্ষণ করা যায়। অতি কচি বা অধিক পরিপক্ক অবস্থায় এসব ফসল সংগ্রহ করলে সংরক্ষণের গুণাগুণ লোপ পায় ফলে সংরক্ষণকাল দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয় না।

শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া ও ইথাইলিন গ্যাসের প্রভাব
শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া : ফসল সংগ্রহের পরও শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চলতে থাকে। শুষ্ক ফসল যেমন ধান, গম ইত্যাদির তুলনায় শাক-সবজি, ফলমূল জাতীয় সতেজ ফসলের শাস প্রশ্বাসের হার অনেক বেশি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় আমাদের সতেজ শাক-সবজি, ফলমূল বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বোহাইড্রেড ভেঙে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প নির্গত হয়। ফলে এসব দ্রব্যের সতেজতা হারিয়ে শুকিয়ে যায়, ওজন কমে, মিষ্টতা কমে, মচমচে ভাব হ্রাস পায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে এবং গ্রাহক চাহিদা প্রায় থাকেই না। শ্বাস-প্রশ্বাস হারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে এসব দ্রব্যের গুণাগুণ হ্রাস পেতে থাকে। গাছ থেকে সংগ্রহের পর, নন-ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল এবং গাছের Storage organ (গাছের যেসব অঙ্গ খাদ্য মজুদ করে রাখে যেমন- গোল আলু, মিষ্টি আলু ইত্যাদি) এর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার ধীর গতিতে কমতে থাকে। অপরপক্ষে কাঁচা ফল ও সতেজ শাক-সবজি’র শ্বাস-প্রশ্বাসের হার (গাছ থেকে সংগ্রহের পর) দ্রুত গতিতে কমতে থাকে। কারণ, এসব দ্রব্যে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার মতো উপাদান (কার্বোহাইড্রেড)-এর মজুদ কম থাকে, যা দ্রুত নি:শেষ হয়ে যায়। অতএব, এসব দ্রব্যের Shelf life বা সংরক্ষণ কাল দীর্ঘ করার একটি প্রধান উপায় হলো সংগ্রহের পর এদের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার হার কমানোর ব্যবস্থা করা।
শ্বাস-প্রশ্বাসের হার পারিপার্শিক কতকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। সাধারণ পারিপার্শিক অবস্থায় এসব দ্রব্যের শ্বাস-প্রশ্বাসের হারও স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু যে কোন ধরনের Stress বা চাপ অর্থাৎ অস্বাভাবিক কষ্টকর পরিস্থিতিতে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়। সাধারণ আলো, রেডিয়েশন বা বিভিন্ন বিশেষ আলোক রশ্মি, গ্যাসীয় পদার্থ (যেমন- ইথাইলিন গ্যাস শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বাড়িয়ে দেয়), রাসায়নিক পদার্থ, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা, শারীরিক আঘাৎ, গ্রোথ রেগুলেট এর ব্যবহার, জলীয় পদার্থের ঘাটতি, রোগ জীবাণুর আক্রমণ ইত্যাদি শ্বাস-প্রশ্বাস হারের উপর প্রভাব ফেলে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর তাপমাত্রার প্রভাব : শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর তাপমাত্রার প্রভাব এতই বেশি যে, পরীক্ষায় দেখা গেছে একটি নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে প্রতি ১০০ সে: তাপমাত্রা বাড়ার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার দ্বিগুণ এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে তিন গুণ হতে পারে। ফলে, উচ্চ তাপমাত্রায় এসব দ্রব্যের সংরক্ষণকাল কমে যায় এবং নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণকাল দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে মতো তাপমাত্রা কমিয়ে ডিপ ফ্রিজে নির্বিচারে আমাদের সব ফলমূল শাক-সবজি সংরক্ষণ করবো এমনটি কিন্তু সম্ভব নয়! সংরক্ষণের তাপমাত্রা খুব বেশি পরিমাণ কমে গেলে Chilling injury and Cold injury হবে অর্থাৎ ঠাণ্ডায় ক্ষত সৃষ্টি হবে। জৈব কোষ গুলোর অভ্যন্তরীণ জলীয় পদার্থ জমে Crystal form করবে অর্থাৎ বরফ হয়ে যাবে এবং কোষের আবরণ ফেটে কোষের অভ্যন্তরীণ পদার্থ বেরিয়ে আসবে। ফলমূল শাক-সবজির আসল গড়ন আর থাকবে না- মচমচে গুণ হারাবে এবং থেল থেলে হয়ে লেতিয়ে পড়বে। স্বাদ, গন্ধ ও তরতাজা আকর্ষণীয় গুণও থাকবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, এমন অবস্থায় ইথাইলিন তৈরির পরিমাণ বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বাড়ে, সালোক সংশ্লেষণের হার কমে, এনার্জি তৈরি কম হয়, জীব কোষ অভ্যন্তরে বিষাক্ত পদার্থ জমে (যেমন- ইথানল, এ্যাসেটালডিহাইড) এবং কোষের গঠন নষ্ট হয়। বিভিন্ন দ্রব্যের জন্য চিলিং ইনজুরি ঘটার তাপ মাত্রার পরিমাণ এক নয়। তবে, স্বাধারণত: ১০০-১৩০ সে: এর নীচের তাপমাত্রায় উদ্যান ফসল (শাক-সবজি, ফলমূল) সংরক্ষণ করলে চিলিং ইনজুরি হয়ে থাকে।

ইথাইলিন গ্যাস ও তার প্রভাব : ইথাইলিন একটি বর্ণহীন গ্যাস যা উদ্ভিদ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করে থাকে। এটি একপ্রকার উদ্ভিদ হরমোন যা Plant growth regulator বা উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। বিশেষত: ফল পাকার ক্ষেত্রে ইথাইলিনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক উপায়ে উদ্ভিদ কর্তৃক সৃষ্ট ইথাইলিন গাছে এবং সংগ্রহ-উত্তর কালে ফল পাকতে সাহায্য করে। ফল পাকার সময় ইথাইলিন উৎপাদনের পরিমাণও বেড়ে যায়। একারণে দেখা যায় যখন দু-একটি ফল (যেমন: আম, কলা) পাকা শুরু করে তখন তা ঢেকে রাখলে তার সাথের অন্যান্য ফলগুলোও দ্রুত পেকে যায়। আর পাকা ফলগুলো বেছে আলাদা করে রাখলে কাঁচা ফলগুলো পাকতে বিলম্ব হয়। আবার ইথাইলিন গ্যাস জীব কোষের Senescence বা বার্ধক্য ত্বরান্বিত করে। ইথাইলিন ফল পাকতে যেমন সাহায্য করে তেমনি সবজির জীব কোষে বার্ধক্য এনে সেগুলোর সতেজতা বিনষ্ট করে পুষ্টি গুণাগুণ নষ্ট করে। ইথাইলিন গ্যাস গাছের পাতায় Senescence ঘটায় ফলে পাতা ঝরে পড়ে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, প্রাকৃতিক উপায়ে উদ্ভিদ যে পরিমাণ ইথাইলিন তৈরি করে ফল পাকাতে সাহায্য করে তা আমাদের শরীরের জীব কোষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে ইথাইলিন গ্যাস সৃষ্টি করে দ্রুত যে ফল পাকানো হয় তা আমাদের শরীরের জীব কোষগুলোকে দ্রুত বার্ধক্যে পৌঁছতে সাহায্য করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা করে দেখা খুবই প্রয়োজন।
ক্লাইম্যাক্ট্রিক (Climactric) ও নন-ক্লাইম্যাক্ট্রিক (Non-climactric) ফল : শ্বাস-প্রশ্বাসের হার ও ইথাইলিন গ্যাস উৎপাদনের হার বিবেচনা করে ফলকে সাধারণত: দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল (Climactric fruits) এবং নন-ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল (Non-climactric fruits) ।

ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল : কতকগুলো ফল পাকার সময় তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বৃদ্ধির হার সুনির্দিষ্টভাবে চারটি স্তরে বিভক্ত হতে দেখা যায়। রেখাচিত্র অংকন করলে দেখা যাবে- এসব ফল পাকার শুরুতে খুব কম সময়ের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের হার কমে যায় (Pre-climactric minimum)। এরপর দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায় (Climactric rise) এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় (Climactric peak), এরপর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার দ্রুত কমে যায় (Post climactric decline)। ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল পাকার সময় ইথাইলিন গ্যাস তৈরি করে যা ফল পাকতে সাহায্য করে। এসব ফল গাছ থেকে সংগ্রহের পরও স্বাভাবিকভাবে পাকার প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং মিষ্টতা বাড়তে থাকে তবে, ফল নরম হতে থাকে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়- আম, কাঁঠাল, কলা, আপেল, পেয়ারা, পেপে, টমেটো, নাসপাতি, প্লাম, চেরি, এভোকাডো, পীচ, ডুমুর (ফিগ), ডুরিয়ান, ইত্যাদি ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল।
নন-ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল : নন-ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফল, গাছ থেকে সংগ্রহের পর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার ক্রমেই কমতে থাকে, কখনই তা বৃদ্ধি পায় না এবং ইথাইলিন গ্যাসও তৈরির পরিমাণও নগণ্য। এসব ফল গাছ থেকে সংগ্রহের পর আর পাকে না, মিষ্টতাও বৃদ্ধি পায় না, বরং মিষ্টতা কমতে থাকে; অভ্যন্তরীণ জলীয় পদার্থ বাষ্পাকারে হারিয়ে যায় এবং ফল শুকিয়ে যায়। নন-ক্লাইম্যাক্ট্রিক ফলের উদাহরণ- আনারস, লিচু, তরমুজ, বাংগী, লেবু, কমলা লেবু, ডালিম, কামরাঙ্গা, রামবুটান, স্ট্রবেরি ইত্যাদি।

সংগ্রহের পর বিভিন্ন ফলমূল, শাক-সবজি’র সংরক্ষণ উপযোগী তাপমাত্রা, বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও কাংক্ষীত সংরক্ষণ কাল নিম্নে উল্লেখ করা হলো- টেবিল নং১
সতেজ ফলমূল,
শাক-সবজি’র নাম সংরক্ষণ উপযোগী
তাপমাত্রা (০ সে:) আপেক্ষিক আর্দ্রতা (%) কাঙ্খিত সংরক্ষণ কাল (দিন/সপ্তাহ/মাস)
গাজর ০ ৯০-৯৫ ২-৫ মাস
ফুল কপি ০ ৯০-৯৫ ২-৪ সপ্তাহ
বাঁধা কপি ০ ৯০-৯৫ ৩-৬ সপ্তাহ
পেঁয়াজ (শুকনা) ০ ৬৫-৭০ ১-৮ মাস
বাংগী ০-৪.৪ ৮৫-৯০ ৫-১৪ দিন
আপেল ১-৪.৪ ৯০ ৩-৮ মাস
সীম (সতেজ) ৫-৭ ৯০-৯৫ ৭-১ দিন
শশা ৭-১০ ৯০-৯৫ ১০-১৪ দিন
কাঁচা মরিচ, ক্যাপসিকাম ৭-১০ ৯০-৯৫ ২-৩ সপ্তাহ
বেগুন ৭-১০ ৯০ ১ সপ্তাহ
ঢেঁড়শ ৭-১০ ৯০-৯৫ ৭-১০ দিন
গোল আলু (সাদা) ৫-১০ ৯৩ ২-৫ মাস
মিষ্টি আলু ১২-১৬ ৮৫-৯০ ৪-৬ মাস
টমেটো (পাকা) ৭-১০ ৮৫-৯ ৪-৭ দিন
টমেটো (কাঁচা) ১২-২০ ৮৫-৯০ ১-৩ সপ্তাহ
এভোকাডো ৪.৪-১২.৫ ৮৫-৯০ ২-৪ সপ্তাহ
আম ১২ ৮৫-৯০ ২-৩ সপ্তাহ
আনারস ৭-১২.৫ ৮৫-৯০ ২-৪ সপ্তাহ
পেঁপে ৭ ৮৫-৯০ ১-৩ সপ্তাহ
সংগ্রহের পর সতেজ শাক-সবজি, ফলমূলের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করার উপায়ঃ
১। মাঠ থেকে শাক-সবজি, ফলমূল সংগ্রহের সঠিক পরিপক্কতা : উপযুক্ত পরিপক্ক অবস্থায় অনুকূল পরিবেশে ফসল সংগ্রহ করলে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময় সে ফসল ঘরে সংরক্ষণ করা যায়। অতি কচি বা অধিক পরিপক্ক অবস্থায় এসব ফসল সংগ্রহ করলে সংরক্ষণের গুণাগুণ লোপ পায় ফলে সংরক্ষণকাল দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয় না।
২। সকালের দিকে, অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে দিনের যে সময় তাপমাত্রা কম থাকে, সে সময়ই ফলমূল, শাক-সবজি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।
৩। ফসল সংগ্রহের পরই সঠিকভাবে বাছাই করে নিতে হবে। পোকা মাকড়, রোগ বালাই মূক্ত অক্ষত ও একই পরিপক্কতা বিশিষ্ট্য দ্রব্য বাছাই করে নিতে হবে।
৪। ফসল সংগ্রহের পর দ্রুত তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রৌদ্রের মধ্যে এসব দ্রব্য ফেলে রাখা ঠিক নয়। দ্রুত ছাঁয়ায় নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ঠাণ্ডা পানিতে ডুবিয়েও এসব দ্রব্যের শারীরিক তাপমাত্রা দ্রুত কমানো যায়।
৫। সংগৃহীত দ্রব্যাদি স্থানান্তরঃ বাণিজ্যিকভাবে অধিক পরিমাণ দ্রব্য দূরে স্থানান্তর করতে হলে দ্রব্যগুলি অবশ্যই প্যাকেজ করে নিতে হবে যাতে স্থানান্তরের সময় ক্ষত না হয়। এছাড়া Cold conveyance বা ঠাণ্ডা গাড়িতে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬। গন্তব্যে পৌঁছার পর দ্রব্যগুলি সংরক্ষণের পূর্বে ভালভাবে বাছাই করে নিতে হবে যাতে কোনো পাকা ফল কাঁচা ফলের সঙ্গে না থাকে। কারণ এমনটি হলে, পাকা ফল থেকে নি:সৃত ইথাইলিন গ্যাস কাঁচা ফলকে দ্রুত পাকতে সাহায্য করবে।
৭। সংরক্ষণের কক্ষটিতে ভাল ভেন্টিলেশন এর ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে করে এসব দ্রব্য থেকে নি:সৃত ইথাইলিন গ্যাস দ্রব্যগুলোর চারিপার্শ্বে না থেকে দ্রুত তা বাহিরের বাতাসের সংগে মিশে যেতে পারে।
৮। বাণিজ্যিকভাবে সংরক্ষণের জন্য CA (Controlled atmosphere) বা নিয়ন্ত্রিত গ্যাসীয় অবস্থায় এসব দ্রব্যাদি সংরক্ষণ করা যায়। স্বাধারণত: বাতাসে ৭৮% ভাগ নাইট্রোজেন, ২১% অক্সিজেন, এবং ০.০৩% কার্বোন-ডাই অক্সাইড থাকে। এসব দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সাধারণত: অক্সিজেন ৮% এর নীচে এবং কার্বোন ডাই-অক্সাইড ১% এরউপরে রাখা হয়।
৯। এসব সতেজ দ্রব্যাদি সংরক্ষণের উপযোগী তাপমাত্রা (০ সে:) ও বাতাসের আর্দ্রতার মাত্রায় (%) ভিন্নতা রয়েছে। প্রতিটি দ্রব্য তার জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও বাতাসের নির্দিষ্ট আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হবে। (উদাহরণ-উপরে উল্লিখিত: টেবিল-১)।
সতেজ ফলমূল, শাক-সবজি পুষ্টির আধার!
সংরক্ষণ করতে হলে, তা নিশ্চয়ই করতে হবে বৈজ্ঞানিক পন্থায়-
তাই, এব্যাপারে কেউ যেন আর না থাকি নির্বিকার।
লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ।